ক্যানসার নিয়েও পরিবেশরক্ষার লড়াই, গোল্ডম্যান পুরস্কার মেক্সিকান তরুণীর

তখন মাত্র ৯ বছর বয়স তাঁর। সবে মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের পর মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে লস অ্যাঞ্জেলিসে। নতুন ঠিকানায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই হঠাৎ করে নাক থেকে শুরু হয়েছিল রক্তপাত। সেইসঙ্গে পেটে ব্যথা, খিঁচুনি, হাঁপানি, মাথাব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ। হঠাৎ এমন অদ্ভুত ঘটনা পরিবারের সবাইকেই বেশ অবাক করে দিয়েছিল। তারপর পাড়া-প্রতিবেশীরা জানিয়েছিলেন শুধু তাঁরই নয়, এই ধরনের উপসর্গ দেখা যায় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই। কিন্তু কী কারণে গণহারে এই অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ?

এই প্রশ্নটাই দীর্ঘদিন তাড়া করেছে কিশোরী নালেলি কোবোকে (Naleli Cobo)। শেষ পর্যন্ত এই রহস্যের সমাধানও করেছিলেন তিনি। বাড়িতে বসে দিন-রাতই তাঁর নাকে আসত ঝাঁঝালো গন্ধ। কখনও আবার এই গন্ধের সঙ্গে মিশত চকোলেট কিংবা চেরির কৃত্রিম সুবাস। কিন্তু এই ঘ্রাণের উৎস কী? বুঝতে অসুবিধা হয়নি, নিকটবর্তী তৈল উত্তোলনকেন্দ্র থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে এই গন্ধ। তবে তখনও পর্যন্ত সবটাই ছিল তাঁর অনুমান। কিন্তু অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই কি দোষারোপ করা যায় কোনো সংস্থাকে? তাই অন্যভাবে লড়াই শুরু করেছিলেন ছোট্ট কোবো। অ্যালেনকো কোম্পানির তৈলকূপ থেকে নির্গত এই ঝাঁঝালো গন্ধ সমস্ত স্থানীয়দেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই গন্ধের উৎস বন্ধ করার জন্য, তাঁদের মধ্যে জনমত গড়ে তোলার জন্য পথে নামেন কোবো। হ্যাঁ, সফলও হয়েছিলেন তিনি।

আজ ২১ বছর বয়স কোবোর। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এবার পরিবেশরক্ষার ‘নোবেল’ পেলেন মেক্সিকান অভিবাসী তরুণী। হ্যাঁ, এই বছরের গোল্ডম্যান পুরস্কার (Goldman Award) বিজেতা তিনিই। 

তবে খুব সহজ ছিল না এই লড়াই। প্রথমত প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতাশালী কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগ দায়ের করা মোটেও মুখের কথা নয়। সেইসঙ্গে শারীরিক অসুস্থতাও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর কাছে। বছর ১২ বয়সেই তাঁর শরীরে ধরা পড়েছিল ক্যানসার। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক মনে করেছিলেন হয়তো জিনবাহিত কারণেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। তবে পরীক্ষা করেও তেমন কোনো সূত্র খুঁজে পাননি চিকিৎসকরা। 

আরও পড়ুন
পৈতৃক ৭০ একর জমিতে ঘন অরণ্য, পরিবেশ রক্ষায় অটল তেলেঙ্গানার প্রৌঢ়

পরবর্তীতে তাঁর করা জনস্বার্থ মামলা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় গোটা ঘটনাটি। কোবো তো বটেই, গোটা জনবসতিতেই অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত ক্যানসারে। সেইসঙ্গে কার্ডিওভাস্কুলার রোগ, জন্মকালেই শিশুমৃত্যুর মতো ঘটনার পরিসংখ্যানও ঊর্ধ্বমুখী। আর তার কারণ, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাতাসে বেঞ্জিন, কার্বন মোনোঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি। যার উৎস নিকটবর্তী তৈল উত্তোলনকেন্দ্র। তৈলখনিতে লিকের কারণেই ক্রমাগত নির্গত হয়ে চলেছিল এই প্রাকৃতিক গ্যাস। 

আরও পড়ুন
পরিবেশ দূষণ রুখছেন নাইজেরিয়ার স্পাইডারম্যান

গত ২০১৯ সালে সাময়িক সাফল্যের মুখ দেখে তাঁর আন্দোলন। লস অ্যাঞ্জেলিস প্রশাসন ৫ বছরের জন্য বন্ধ রাখে এই কূপের খননপ্রক্রিয়া। তবে তাতেই স্থায়ী সমাধান মেলেনি। এখনও অল্পবিস্তর গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বন্ধ তৈল উত্তোলনকেন্দ্র থেকে। পাশাপাশি বছর দুয়েকের মধ্যে ফের এই কারখানা চালু হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে ক্লান্ত হননি কোবো। অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার পরেও, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের স্থানীয়দের সুরক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছেন তিনি। লড়াই করে চলেছেন পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে। লক্ষ্য, স্থায়ীভাবে এই কারখানাকে বন্ধ করা। অভিবাসী বীরঙ্গনার এই লড়াইকেই এবার স্বীকৃতি জানাল গোল্ডম্যান কমিটি… 

আরও পড়ুন
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পরিবেশ-বন্যপ্রাণের 'মৃত্যু'

Powered by Froala Editor