উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই। সাদা টি-শার্টের ওপর চাপানো জ্যাকেট। আর তার ফাঁক দিয়েই উঁকি দিচ্ছেন চে। বাঁ হাতেও ঝলমলাচ্ছে চে-এর ট্যাটু। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম বিতর্কিত এই চরিত্র বার বারই স্পষ্টভাষী সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছেন। সে কর্মজীবনই হোক কিংবা তার পরবর্তী সময়ে ফিফা, ব্যাঙ্কিং সিস্টেম, রাজনীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশনীতি এমনকি ক্যাথলিকের বিরুদ্ধেও মুখ খুলতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
কিন্তু একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এক অন্য মারাদোনার হদিশ পাওয়া এমন কিছু দুষ্কর নয়। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তখন কার্লোস মেনেম। শুরুর দিকে আদপে গোঁড়া দক্ষিণপন্থী সেই মেনেমেরই অন্যতম সমর্থক ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। কিন্তু মারাদোনার ভাবমূর্তি, কথাবার্তা এবং বক্তব্যে বারবারই ফুটে উঠে বামপন্থারই ছাপ। কীভাবে হল এই বদল?
১৯৮৭ সাল। ততদিনে হয়ে গেছে বিশ্বকাপ জয়। হয়ে গেছে ব্যালান ডি’ওর প্রাপ্তিও। ডাক এল কিউবা থেকে। প্রেসনা ল্যাটিনা এজেন্সি ল্যাটিন আমেরিকার উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া প্রতিভাদেরই তখন দিয়ে থাকে একটি বিশেষ সম্মান। সেই পুরস্কারই সেবার হাতে পাচ্ছেন মারাদোনা। জীবনে প্রথমবারের জন্য পা রাখলেন কিউবায়। অনুষ্ঠান হল আশাপ্রদই। তবে তার ফাঁকেই ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। আলাপ হল কিউবার রাষ্ট্রনেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে। দক্ষিণপন্থী মারাদোনা এড়িয়ে যেতে পারলেন না আড্ডার আমন্ত্রণ। দুই কিংবদন্তির মধ্যে গল্প চলল টানা ঘণ্টা পাঁচেক।
যাকে বলে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। অনেকটা যেন তেমনই ছিল দুই কিংবদন্তির সেই সাক্ষাৎকার। এক কথায় ভক্ত হয়ে পড়লেন তিনি ফিদেলের। বলাই বাহুল্য, সেই আড্ডাতেই বারবার উঠে এসেছিল চে গেভারার কথা। আর সেই আলাপ-আলোচনাই কি বদলে দিয়েছিল মারাদোনার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে? হয়তো তাই-ই। হয়তো ফিদেলই তাঁর মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন চে গেভারার মতাদর্শের বীজ। অন্তত এমির কুস্তুরিকার তৈরি তথ্যচিত্রে অনেকটা তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। বার বার সরব হওয়ার কারণ জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন, “কিউবা ভ্রমণ আর চে গেভারার জীবনী আমাকে এমনটাই শিখিয়েছে”। অথচ পারতপক্ষে চে’র ব্যাপারে খানিকটা উদাসীনই ছিলেন তিনি।
পরবর্তীকালেও বারবার নিজের দুঃসময় কিউবাতেই আশ্রয় খুঁজেছেন মারাদোনা। ১৯৯৪ সালে ড্রাগ চক্রে বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে বাদ যাওয়ার পর তাঁর ঠিকানা হয়েছিল সেই কিউবাই। ২০০০ সালে অসুস্থতার সময়ও তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। মারাদোনাই কাস্ত্রোর আন-অফিশিয়াল স্পোকসপারসন— এমন কথাও ছাপা হয়েছিল সে সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
আরও পড়ুন
প্রয়াত ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা
বামপন্থার প্রতি পরবর্তী সময়ে এই প্রীতি থেকেই কি তাঁর নাম ষড়যন্ত্রে জড়িয়েছিল সিআইএ? উঠে আসে অভিযোগও। তবে মাদকাসক্ত ছিলেন না মারাদোনা, তেমনটাও নয় একেবারেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবল কি বাদ রাখতে পারে ধনতন্ত্রকে? কাজেই মারাদোনার যাপনের মধ্যেও মিশে গিয়েছিল সেই ছায়া। খেলেছেন ইতালির মতো চরম ধনতান্ত্রিক দেশে। অবসরগ্রহণের পরেও বিলাসবহুল জীবনেও অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। তবুও তার উল্টোদিকেই ‘দ্বিতীয় পিতা’ বলে ফিদেল কাস্ত্রোকে অভিহিত করেছেন তিনি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন ভেনেজুয়েলার সমাজপন্থী সরকারের সঙ্গে।
আসলে তিনি যাতেই হাত লাগান, দানা বাঁধে বিতর্ক। কাজেই এমন একটা চরিত্রের সামনে প্রশ্ন উঠে আসা তো অবশ্যম্ভাবী। তবে সমাজতন্ত্রের বিষয়েও আরও অনেক ক্লাস নেওয়াই বাকি রয়ে গেছে তাঁর। কাস্ত্রোর মৃত্যুতে বছর চারেক আগে এমনই বলেছিলেন মারাদোনা। সেটাও ছিল একটা ২৫ নভেম্বরের হালকা শীতের দিন। ফুটবলের জাদু দেখানো, বাঁ পায়ের শিল্পী সেই একই দিনে পাড়ি দিলেন অদৃষ্টে। এও অদ্ভুত সমাপতন যেন। সমাজতান্ত্রিক সত্তার পিছনে লুকিয়ে রাখা ক্যাপিটালিজমকেই হয়তো পুরোপুরি মুছে ফেলতেই আরও একবার ক্লাস নিতে গেলেন তিনি অগ্রজের কাছে...
আরও পড়ুন
মোহনবাগানের ‘কাঁচা হিরে’ তিনি, প্রয়াত প্রাক্তন ফুটবলার সত্যজিৎ ঘোষ
Powered by Froala Editor