কিউবার হাভানা শহর। সেখানকার ১৭ স্ট্রিটের কাছেই ছোট্ট এক ফালি পার্ক। আর সেই পার্কের লোহার বেঞ্চিতে রয়েছে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। এই মূর্তি দেখতেই ছুটির দিনে ভিড় জমে যায় এই পার্কে। মূর্তিটি আর কারোর নয়, কালজয়ী ব্যান্ড বিটলসের কিংবদন্তি গায়ক জন লেননের। কিউবার নাগরিকদের কাছে তিনি একজন ‘গণদেবতা’-ই বটে। তবে যে জন লেননের মাদকতা আজ কিউবা জুড়ে, সেই লেননকেই একদিন নিষিদ্ধ হতে হয়েছিল বিপ্লবের দেশে।
১৯৬৪ সাল। বাতিস্তার হাত থেকে কিউবা ‘মুক্তি’-র পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৫ বছর। তবে স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হলেও থিতু হয়নি রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কিউবা বামপন্থী দেশ হওয়ার কারণে সমস্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে আমেরিকা। পাশাপাশি কিউবার সঙ্গে সোভিয়েতের সম্পর্কও ভাবিয়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কাজেই একাধিকবার অধিগ্রহণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিআইএ।
একদিকে কিউবান বিপ্লব সফল করার পর যখন দেশকে গুছিয়ে নেওয়ার করছেন ফিদেল কাস্ত্রো। তখন পৃথিবীর আরেক দিকে জন্ম নিয়েছে আরেক বিপ্লব। তবে তার সঙ্গে বন্দুকের যোগ নেই কোনো। বরং গান আর সুরই অস্ত্র সেই বিপ্লবের। কথা হচ্ছে ব্রিটেনের কালজয়ী ব্যান্ড দ্য বিটলসের ব্যাপারে। যার ঢেউ যুক্তরাজ্যের সীমা পেরিয়ে ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। সেই জোয়ার থেকে বাদ নেই আমেরিকাও।
কিউবার প্রধান শত্রু আমেরিকায় বিটলসের সাদর আমন্ত্রণই ভাবিয়ে তুলেছিল ফিদেল কাস্ত্রোকে। তিনি ভেবেছিলেন দেশের সংকটজনক অবস্থায় এই গানের জোয়ারই ক্ষয়ীভূত করতে পারে নাগরিকদের বৈপ্লবিক মতাদর্শকে। পাশাপাশি আমেরিকার পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী মানসিকতার প্রভাব প্রকট হবে কিউবায়। সেই সম্ভাবনাকেই গোড়ায় নির্মূল করতে ১৯৬৪ সালে দেশে ‘দ্য বিটলস’ এবং জন লেননের সমস্ত গান নিষিদ্ধ করেন ফিদেল কাস্ত্রো।
তবে তাতে যে সম্পূর্ণভাবে আটকানো গিয়েছিল লেননকে, তেমনটা নয়। লুকিয়ে, চুরিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মাঝে মধ্যেই কিউবায় ঢুকে পড়ত বিটলসের রেকর্ড। সত্তরের দশকে গোপনেই রক সঙ্গীতে মজতেন কিউবান তরুণরা। অংশ হতেন বৃহত্তর এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের।
তবে যত দিন গড়িয়েছে, লেননের ব্যাপারে ধারণাও বদলে গিয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রোর। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ— এক অন্য জন লেননকেই ধীরে ধীরে চিনেছিলেন কিউবার রাষ্ট্রনেতা। পশ্চিমি পুঁজিবাদ এবং বিদেশি ভূখণ্ডে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ব্যাপারেও সরব হয়েছিলেন লেনন। এমনকি লেননকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে— এমনটাও হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরিস্থিতি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত গ্রিন কার্ড পান তিনি। লেননের এই মানসিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। তবে দেখা করা হয়ে ওঠেনি আর ‘বিপ্লবী’ লেননের সঙ্গে। ১৯৮০ সালেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী।
আরও পড়ুন
সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি গির্জার, নতুন যুগের সূচনা ফিদেল কাস্ত্রোর দেশে
লেননের প্রভাব এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল ফিদেল কাস্ত্রোকে যে, জন লেননের মৃত্যুর ২০ বছর পরে লেননকে নায়কের মর্যাদা দেন ফিদেল কাস্ত্রো। ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর লেননের মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজন করেন একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান। যাতে শিল্পীরা উপস্থাপন করেছিলেন শুধু লেননেরই গান। সেইসঙ্গে মোনাকাল পার্ককে ফিদেল বদলে দেন ‘জন লেনন পার্ক’-এ। স্থাপন করেন লেননের একটি পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তি। এছাড়াও ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারকে দিয়ে জন লেননের ওপর একটি তথ্যচিত্রও বানিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।
কাস্ত্রোর প্রতিষ্ঠিত লেননের সেই ব্রোঞ্জ মূর্তিটি ‘পূজিত’ হয় আজও। এমনকি লেনন-মাদকতার জেরে সেই মূর্তি থেকে প্রায় দিনই চুরি যায় লেননের চশমা। যে কারণে শুধু চশমার জন্যই এক বিশেষ প্রহরীকে নিযুক্ত করে রেখেছে কিউবা প্রশাসন। তবে আজকের কিউবার পরিস্থিতি দেখলে কখনও বোঝা সম্ভব হবে না যে এই দেশে একদিন নিষিদ্ধ ছিলেন স্বয়ং ‘জননায়ক’-ই।
আসলে জন লেনন এবং ফিদেল কাস্ত্রো— দুই কিংবদন্তিই ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বপ্নের দিশারী। শুধু একে অপরকে চিনতে সময় লেগে গিয়েছিল বেশ খানিকটা...
আরও পড়ুন
ফিদেল কাস্ত্রো-র সংস্পর্শে নবজন্ম মারাদোনার; মৃত্যুতেও ছুঁয়ে রইলেন ‘দ্বিতীয় পিতা’কেই
Powered by Froala Editor