মিষ্টির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অতি নিবিড়। শেষপাতে মিষ্টিমুখ না হলে খাবারই হজম হয় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির রসনা বদলেছে। অথচ মিষ্টি তৈরির শিল্পে কি সেভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে? দেখা যাবে আজও মিষ্টি তৈরি বলতেই সেই আদ্যিকালের বড়ো বড়ো কড়াইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাতা নাড়ছেন ময়রা। এই পরিচিত দৃশ্যটাই বদলে দিতে চেয়েছেন অমিতাভ মোদক। শহর কলকাতা থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে রিষড়া শহরে ফেলু মোদকের মিষ্টির দোকানেই চলছে এই আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া।
না, ফেলু মোদকের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্রটির কোনো সম্পর্ক নেই। এই ফেলু বাবুর বয়স ১৫০ বছরের বেশি। দোকানের বর্তমান মালিক অমিতাভ মোদকের ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন ফেলু মোদক। আর দোকানটি তৈরি করেছিলেন তাঁর বাবা। অর্থাৎ ৬ প্রজন্মের এই দোকান। বয়স অন্তত ১৭৫ বছর। এই দোকানের মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। সেই জনপ্রিয়তা আজ এত বছর পরেও অক্ষুণ্ণ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকেই ফেলু মোদকের মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেছেন।
বংশের রীতি মেনে দোকানের হাল ধরেছেন অমিতাভ মোদক। তবে তিনি সম্পূর্ণ চেহারাই বদলে ফেলেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে অমিতাভ বাবু ভাবলেন, তাঁর অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাবেন নিজের দোকানেই। যেমন ভাবনা তেমনি শুরু হল কাজ। রাবরি থেকে রসগোল্লা, পান্তুয়া অথবা জলভরা সন্দেশ, সবই তৈরি হয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে। হ্যাঁ, পৃথিবীতে প্রথম রসগোল্লা পাকানোর যন্ত্রটিও তৈরি করেছেন অমিতাভ বাবুই। যন্ত্রের মাধ্যমে মিষ্টি তৈরি হওয়ায় যেমন তার গুণমান একই থাকে, তেমনই পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর রাখা যায়।
আগে অবশ্য দোকানের চেহারা ছিল একেবারেই সাদামাটা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে তার চেহারা। শুধু বদলায়নি স্বাদ। আজও খাঁটি গরুর দুধের ছানা, ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয় মিষ্টি। ল্যাংচা, পান্তুয়া ভাজা হয় খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে। স্বাদে, গন্ধে, চেহারায় ক্রেতাদের মন ভরিয়ে তোলে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারেও পৌঁছে গিয়েছে ফেলু মোদকের খ্যাতি। রিষড়া থেকে প্যাকেটবন্দি হয়ে সেই মিষ্টি পৌঁছে যায় ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলিতেও। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত কাজ করে চলে যন্ত্রগুলি। একটি যন্ত্র থেকে এক ঘণ্টায় সাড়ে ৩ হাজার রসগোল্লা তৈরি হয়। তবে শহর কলকাতার মানুষকে এই স্বাদ পেতে গেলে যেতে হবে সেই রিষড়া। খরদহ শ্যামসুন্দর ঘাটের থেকে গঙ্গা পেরিয়ে একটু বাঁদিকে গেলেই জিটি রোডের উপর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ছিমছাম দোকানটি দেখা যাবে। দাম একটু বেশি হলেও মিষ্টির স্বাদ হতাশ করে না কোনো ক্রেতাকেই। অমিতাভ বাবু অবশ্য কলকাতার বুকেও একটি আউটলেট খোলার কথা ভাবছেন। তবে তার জন্য অপেক্ষা না করে একটু সময় হাতে নিয়ে চলে আসুন রিষড়ায়। গঙ্গার ধারের পরিবেশের সঙ্গে ১৭৫ বছরের ঐতিহ্যশালী দোকানের মিষ্টির স্বাদ সত্যিই মন ভরিয়ে দেবে।
ছবি – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
তথ্যঋণঃ
১. নারকেল ফুল থেকে সুগার-ফ্রি অমৃত বানাচ্ছে ফেলু মোদক, ভাস্কর সিংহরায়, বঙ্গদর্শন
২. Felu modak | 175 year old sweet shop from Rishra, Indrajit Lahiri, Youtube
৩. ফেলু মোদক ও বাজপেয়ী, সুকান্ত সরকার, এইসময়
Powered by Froala Editor