১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসুর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'গড্ডলিকা'। এর আগে শনিবারের চিঠি এবং একাধিক মাসিক পত্রিকায় পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তবে দেখতে দেখতে যে প্রথম সংস্করণের সবকটি বই বিক্রি হয়ে যাবে, একথা তিনি ভাবতে পারেননি। আর হবে নাই বা কেন! নবাগত এই লেখকের বইয়ের সমালোচনা যে লিখেছেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!
কিন্তু এবার বিপদে পড়লেন বাংলার আরেক প্রবাদ পুরুষ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালসের ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজ করতেন রাজশেখর বসু। ধীরে ধীরে বেশ উন্নতি করছিলেন গবেষণার কাজে। এমনকি, রাজশেখর তখন বেঙ্গল কেমিক্যালসের ম্যানেজারের পদে। আচার্যও তাঁর শিষ্যকে পেয়ে খুশি ছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানের জগৎ ছেড়ে এবার কি সেই শিষ্য সাহিত্যের জগতেই পাকাপাকি ঘর বাঁধতে চলেছে? খানিক ঘাবড়েই গেলেন প্রফুল্লচন্দ্র। চিঠি লিখলেন কবিগুরুকে। অভিযোগের তির সরাসরি তাঁর দিকেই। পরশুরাম যে এবার "আমাকে (প্রফুল্লচন্দ্রকে) অসহায় রাখিয়া ত্যাগ করিতে ইচ্ছুক হইতে পারেন", এই আশঙ্কার কথা সরাসরি জানালেন প্রফুল্লচন্দ্র।
প্রফুল্লচন্দ্রের এই আশঙ্কার জন্য যে রবীন্দ্রনাথই দায়ী, একথা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। স্বয়ং কবিগুরুর কাছ থেকে সংশাপত্র পেলে আর নিজের সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কে তার সংশয় থাকবে কেন? রবীন্দ্রনাথও সেই চিঠির উত্তর দিতে দেরি করেননি। বিজ্ঞানাচার্যকে সরাসরি তিনি জানালেন, "যেসব জন্ম সাহিত্যিক গোলমেলে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁদের ফের জাতে তুলবো।" এমনকি তিনি যে স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্রকে পুরোদস্তুর সাহিত্যিক করে তুলতে চান, সেই উদ্দেশ্যের কথাও জানান।
বাংলার ও বাঙালির সম্পূর্ণ পৃথক দুই জগতের দুজন পথিকৃতের সম্পর্ক ছিল এমনই। সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক, অথচ তার মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার কোনো অভাব ছিল একই বছরে জন্ম দুজনের। ফারাক মাত্র কয়েক মাসের। সারাজীবন সম্পর্কও ছিল সেইরকম। বিজ্ঞানাচার্যের নিজের কথায় জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। সেখানেই পড়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিষবৃক্ষ' উপন্যাসটি। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখাও যে পড়েননি, তাই বা হয় কী করে? বরং রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে যে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল, সেকথা প্রমাণিত হয় চিন্মোহন সেহানবিশের স্মৃতিচারণায়। জানা যায়, প্রফুল্লচন্দ্রের ৭০তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর সেদিন পুরোদস্তুর বিজ্ঞানীর গলাতেও সবাই শুনেছিলেন 'পূরবী', 'বলাকা', 'কথা ও কাহিনী' কাব্যগ্রন্থ থেকে অসংখ্য কবিতা। সম্পূর্ণ নিজের স্মৃতি থেকে মুখস্থ বলেছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ অবশ্য স্বদেশি আন্দোলনের সূত্রে। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথ যেদিন ব্রিটিশ আইন ভেঙে রাখিবন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন, সেদিন তাঁর সাহসিকতায় অনেকের মতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। আর রবীন্দ্রনাথের মন্ত্রই যে বাঙালির কাজের পিছনে শ্রদ্ধা এবং জাতীয়তার পিছনে গভীর দেশপ্রেমের জন্ম দিয়েছিল, সেকথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি। আর শুধু তো তাই নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে তাঁর মনও মেতে উঠত। সেই সুরের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন 'বাংলার নিগূঢ় রসোচ্ছ্বাস'। জয়দেব থেকে শুরু করে বৈষ্ণব কবিদের গানে যে প্রেমরসের প্রকাশ, তাকেই তো নতুন রূপে হাজির করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলার সঙ্গে যে তাঁর নাড়ির টান! সেই টান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা স্বয়ং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রেরও ছিল না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আচার্যের যে শ্রদ্ধা ছিল, তার সুললিত প্রতিধ্বনি উঠেছিল অপর দিকে থেকেও। প্রফুল্লচন্দ্রের কথা বলতে বলতেও উদ্বেল হয়ে উঠতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তো বলেছিলেন, "সংসারে জ্ঞানী তপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে চরিত্রে ক্রিয়া প্রভাবে তাকে ক্রিয়াবান করতে পারে এমন মনীষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়।"
সাহিত্য আর বিজ্ঞানের জগৎকেআমরা বরাবর আলাদা ভাবে দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু যুগে যুগে এই দুই জগতের গভীর মেলবন্ধনের ইতিহাস তো অল্প নয়। তার কতটুকুই বা খোঁজ রাখি আমরা? রসায়নের জগতের নিচে কোথায় যেন চাপা পড়ে গিয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের আবৃত্তি করা কবিতা। শোনা যায়, শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গীতকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আর রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো বিজ্ঞানের সমাদর করতে অবহেলা করেননি কখনও। তবে সেসবই এখন বিস্মৃত অতীত। কিছু চিঠি আর প্রবন্ধের তলায় চাপা পড়ে আছে দুই 'বন্ধু'র সম্পর্ক।
তথ্যসূত্র: প্রসঙ্গ: প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সম্পাদনা - অমলেন্দু ভট্টাচার্য