হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছেন বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক। সুঠাম চেহারা। রীতিমত কাতরাচ্ছেন তিনি। তাঁর পেটে, উরুতে বিঁধে আছে গুলি। যুবক বুঝতে পারছেন, মৃত্যু ক্রমশ কাছে চলে আসছে। তেষ্টায় শুকিয়ে যাচ্ছে গলা। হাসপাতালের ওই কক্ষেই উপস্থিত ছিলেন এক ডাকসাইটে ইংরেজ পুলিশ অফিসার। যুবকের অবস্থা দেখে গ্লাসে করে জলও নিয়ে আসেন সেই অফিসার। না, সেটা মুখেও তোলেনি যুবকটি। মৃত্যুর মুখেও হার মানতে শেখেননি। কিশোর বয়সে বাঘের সঙ্গে প্রায় খালি হাতে যুদ্ধ করে এসেছেন। তাঁর কাছে এই মৃত্যু কী আর এমন! জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এতটাই কঠিন ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বাঘা যতীন।
ছোট থেকেই এমন নির্ভীক তিনি। যেমন তাঁর গায়ের জোর, তেমনই তাঁর দুর্দমনীয় সাহস। শুধুমাত্র ছোট্ট ছোরা নিয়ে একটা বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের কাহিনি তো কিংবদন্তি হয়ে গেছে। সেরকমই কিংবদন্তি হয়েছেন বাঘা যতীন নিজেও। যুগান্তর দলের অন্যতম প্রধান নেতা, অরবিন্দ ঘোষ-বারিন ঘোষের সঙ্গে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড— সমস্ত দিক থেকেই তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। এমনকি, নিশ্চিন্তের সরকারি চাকরি ছাড়তেও কুণ্ঠা বোধ করেননি।
সালটা ১৯১৫। বালেশ্বরের বুড়িবালামের তীরে অপেক্ষা করছেন পাঁচজন বিপ্লবী। ছদ্মবেশে আছেন তাঁরা। নেতৃত্বে বাঘা যতীন। অপেক্ষা জাহাজের। সেখান থেকে আসবে অস্ত্র। মাউজার পিস্তল। বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিতে হবে। এতকিছুর মধ্যেও সতর্ক হয়ে উঠলেন বাঘা যতীন। ব্রিটিশ পুলিশের একটা বিশাল বাহিনী ঘিরে ফেলল ওই অঞ্চল। এর পরবর্তী কাহিনি আমরা সবাই জানি। বিপ্লবীদের একজন, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী মারা যান ঘটনাস্থলেই। গুরুতর আহত অবস্থায় বালেশ্বর হাসপাতালে ভর্তি হন বাঘা যতীন।
মৃত্যুর চরম মুহূর্তেও তিনি ছিলেন কঠিন, নির্ভীক। ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে ছিলেন কুখ্যাত পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্ট। বাঘা যতীনের অবস্থা দেখে জল এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখান করেছিলেন যতীন্দ্রনাথ। জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি যার রক্ত দেখতে চেয়েছিলাম, তাঁর দেওয়া জলে আমার তেষ্টা মেটাতে চাই না।’
সেই হাসপাতালেই মারা যান বাঘা যতীন। কিন্তু তাঁর এই সাহস মুগ্ধ করে টেগার্টকে। চরম শত্রু হলেও, বাঘা যতীনের এই বীরত্ব তাঁকে স্তম্ভিত করেছিল। না, জল প্রত্যাখানের পর কোনভাবে ক্রুদ্ধ হননি তিনি। পরবর্তীকালে বাঘা যতীনকে সম্মান ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছিলেন টেগার্ট। বলেছিলেন –
“Unfortunately, he is dead… I had to do my duties, but I have a great admiration for him. He was the only Bengalee who died fighting from a trench.”
এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় আলেকজান্ডার-পুরুর দৃশ্য। চরম শত্রুরও সাহসিকতায় সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন টেগার্টও। পার্থক্য একটাই, পুরুর মতো রাজ্য ফিরে পাননি বাঘা যতীন। মারা গিয়েছিলেন। বাঘের সঙ্গে লড়াই করা এক যুবক, নিজের শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। বাঘের মতোই।
ঋণ - বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ/ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় (প্রকাশসাল - ১৯৪৭)
Powered by Froala Editor