প্রতি সন্ধ্যায় গড়ের মাঠে আড্ডা জমাতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, ‘ময়দান ক্লাবের আড্ডা’ নাম দিলেন গান্ধীজি

আজ ২ আগস্ট বিশ্ববিশ্রুত রসায়নবিদ তথা বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ১৫৯ তম জন্মদিন। বর্তমানের এই ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালের নাম বারে বারে উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। আমরা জানছি যতক্ষণ পর্যন্ত না এই রোগের সঠিক ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে, বেঙ্গল কেমিক্যালে নির্মিত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, (Hydroxychloroquine) সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে এই মারণ রোগের চিকিৎসায়। বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক মহলের অভিমত, এটিই এখনো পর্যন্ত একমাত্র ওষুধ যা আংশিক ভাবে হলেও করোনার চিকিৎসায় কাজ দিচ্ছে। তবে বর্তমান রচনায় কোনো গুরুগম্ভীর বিষয় নয়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের আড্ডাপ্রিয়তা নিয়ে সামান্য আলোচনা করব, যা থেকে এই ঋষিতুল্য মানুষটির প্রাত্যহিক জীবনের একটি দিক পাঠকের নজরে আসবে।

একসময় (১৯১০-১১ সাল) ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বাড়িটির পরিচয় ছিল ‘ডাক্তারবাবুর মেস’। ডাক্তারবাবু বলতে ডা. প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে বোঝাত। তিনি অবশ্য সেখানে থাকতেন না। তবে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজ শেষ করে ঘোড়ায় টানা 'ভিক্টোরিয়া' গাড়ি চেপে প্রায় প্রতিদিন বিকালেই এখানে আসতেন তাঁর প্রিয় ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। সেই মেস বাড়িতে তখন থাকতেন মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর ছোটভাই ভুপেন্দ্রনাথ ঘোষ, নীলরতন ধর ও তাঁর ছোটভাই জীবনরতন ধর, সতীশচন্দ্র সেন ও তাঁর ছোটভাই ক্ষিতীশচন্দ্র সেন প্রমুখ। এঁরা সকলেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের কৃতী ছাত্র বা ছাত্রস্থানীয়। মেঘনাদ সাহা তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অঙ্ক অনার্সের ছাত্র, সঙ্গে পড়ছেন রসায়নশাস্ত্র ও পদার্থবিদ্যা। তাঁর সতীর্থ জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি ও নীলরতন ধর। 

এই মেস-বাড়ির দরজায় প্রায় দিনই বিকালে এসে দাঁড়াত প্রফুল্লচন্দ্রের গাড়ি, কোনো কোনো দিন অধ্যক্ষ গিরিশচন্দ্র বসু বা কবিরাজ উপেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়ের গাড়িও। তাতে চড়ে সকলে মিলে যেতেন ময়দানে লর্ড রবার্টের মূর্তির নিচে (স্বাধীনতা লাভের পর এই মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে)। সেখানে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলত ইতিহাস, সমাজ-সংস্কৃতি, যুদ্ধের গল্প ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গের তুমুল আলোচনা। শোনা যায় গড়ের মাঠের এই আড্ডার কথা গান্ধীজির কানেও পৌঁছেছিল এবং তিনি এই হাইলি এস্টিমড আড্ডার নামকরণ করেছিলেন ‘ময়দান ক্লাবের আড্ডা’।

এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন অবশ্যই প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁকে ঘিরে সবাই ঘাসের উপর বসতেন। আড্ডার সদস্যদের বিশেষ বিশেষ নামকরণ হয়েছিল আচার্যদেবের হাতে। যেমন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি আর জ্ঞান রায়কে তিনি ডাকতেন 'জ্ঞানত্রয়' বলে। জ্ঞান রায় প্রফুল্লচন্দ্রের সমস্ত বক্তৃতা লিখে রাখতেন বলে তাঁর আরও একটি নাম জুটেছিল – ‘গণেশ’। দেবপ্রসাদ ঘোষ যুদ্ধের কৌশল আলোচনায় খুব উৎসাহী ছিলেন বলে তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘ট্যাকটিশিয়ান’। আড্ডার আর একজন সদস্য সত্যানন্দ বসু সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলে যেতেন বলে তাঁকে ডাকা হত ‘স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল’ বলে।

আরও পড়ুন
ইংরেজদের সমালোচনা করে নিবন্ধ লিখলেন প্রফুল্লচন্দ্র, চিঠি পেলেন ব্রিটিশ সাংসদের

‘জ্ঞানত্রয়’-এর অন্যতম জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সহধর্মিণী নীলিমা ঘোষ এই আড্ডা প্রসঙ্গে লিখেছেন – ‘সারাদিনের কাজের পর সন্ধ্যেবেলায় বড় আকাশের তলায় না বেড়ালে তাঁর (প্রফুল্লচন্দ্রের) মন ভরত না। এইসময় তাঁর প্রিয় ছাত্রদের নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ময়দানে বেড়াতে যেতেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে ওঁর অনেক রকম আলাপ আলোচনা হত। আমার বিয়ের পর আমাদের দুজনকে একদিন নিয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে মেয়েদের বাইরে যাওয়ার ততটা চল ছিল না। সেই আমি প্রথম বাইরে বের হলাম। সেদিনকার সেই অদ্ভুত অনুভূতি আমি কোনদিন ভুলব না।’

আরও পড়ুন
বেঙ্গল কেমিক্যালসের ম্যানেজারের লেখায় মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ, ঘাবড়ে গেলেন প্রফুল্লচন্দ্র

ময়দান ক্লাবের আর একজন সদস্য নিত্যানন্দ বসু চৌধুরী এই আড্ডার স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে: ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সান্ধ্যকালে গড়ের মাঠে যে আড্ডা ছিল – আড্ডা নহে, নৈমিষারণ্য – বহুকাল তাহার নগণ্য সভ্য থাকিবার আমার সৌভাগ্য হইয়াছিল। সরল ও নিম্নশ্রেণীর লোকের জন্য দরদী এমন লোক দেখি নাই। সুরেন্দ্রনাথের কংগ্রেসের সেক্রেটারি এবং ক্যাশিয়ার শ্রদ্ধেয় সত্যানন্দ বসু, ঢাকা মালকানগরের জমিদার প্রফুল্লবাবু সকলেই দিগগজ – তাঁহারাও এই নৈমিষারণ্যের সভ্য ছিলেন।’

আরও পড়ুন
দুর্ভিক্ষে-বন্যায় ধ্বস্ত বাংলা, রিলিফ ফান্ড তৈরি করলেন প্রফুল্লচন্দ্র, সঙ্গী তরুণ সুভাষ

তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। পরাধীন ভারতের সব জায়গায় তাঁদের নির্লজ্জ দাপট। এমনকি ইংরেজ বালক বালিকাদের আচরণেও এই মনোভাবের প্রকাশ দেখা যেত। তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন ময়দান ক্লাবের সদস্যরা। বিষয়টি প্রাঞ্জল হবে পূর্বোক্ত নিত্যানন্দ বসু চৌধুরীর রচনা থেকে আর একটু তুলে দিলে: ‘গড়ের মাঠে প্রিন্সেপ ঘাটের যে ইমারত আছে তাহার সম্মুখে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুইটি পাথরের সিংহ-মূর্তি আছে। একদিন সন্ধ্যাকালে দক্ষিণ দিকের সিংহ-মূর্তির উপরে কতকগুলি বাঙালি বালক-বালিকা এবং উত্তর দিকের সিংহ-মূর্তির উপরে কতকগুলি ইংরাজ বালক বালিকা খেলা করিতেছিল। কি খেয়াল হইল ইংরাজ বালক-বালিকারা তাহাদের উত্তর দিকস্থ সিংহের আসন ত্যাগ করিয়া দক্ষিণ দিকস্থ সিংহ-মূর্তির উপর ক্রীড়ারত বাঙালি বালক-বালিকাদের আক্রমণ করিল। বাঙালি বালক-বালিকারা তৎক্ষণাৎ কোনো বাধা না দিয়া তাহাদের দক্ষিণ দিকস্থ আড্ডা ত্যাগ করিয়া উত্তর দিকস্থ সিংহ-মূর্তির কাছে আড্ডা লইল। কিছুক্ষণ পরে দক্ষিণ দিকস্থ তাহাদের নূতন আড্ডা ত্যাগ করিয়া ইংরাজ বালক-বালিকারা উত্তর দিকস্থ বাঙালি বালক-বালিকাদের দ্বিতীয়বার আক্রমণ করিল। এইবার বাঙালি বালক-বালিকারা তাহাদের স্থান ছাড়িয়া না দিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধার মতো সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া ইংরাজ  বালক-বালিকাদের হটাইয়া দিল। আমরা সকলে এই যুদ্ধ দেখতেছিলাম। বাঙালি বালক-বালিকারা শেষে কৃতকার্য হইল দেখিয়া আচার্যদেব ক্রীড়ামোদী বালকের মতো হাত তুলিয়া নাচিতে লাগিলেন। তিনি আমাদের লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমরা কি বালক-বালিকাদের মতো সাহেবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না?”’

সেদিনের সেই ঘটনা প্রফুল্লচন্দ্রের মনকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য – উদারতা। প্রথমে আক্রান্ত হয়েও বাঙালি বালক-বালিকারা নিজেদের জাতীয় উদারতা দেখিয়ে ইংরেজ বালক-বালিকাদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হতে তারা বীরের মতো লড়াই করে আত্মমর্যাদা বজায় রাখল। প্রফুল্লচন্দ্র এই দৃশ্য দেখে বেজায় খুশি। তাঁর শিষ্যদেরকে বার বার বলতে লাগলেন, ‘আমরা কি ইংরেজদের সঙ্গে এইভাবে লড়াই করতে পারতাম?’

Powered by Froala Editor

Latest News See More