প্রাণহানি, অসম্পূর্ণ পড়াশোনা, বন্দিত্ব— তালিবান-জমানায় মহিলাদের ভবিতব্য?

গত রবিবারের কথা। কাবুল থেকে ১২৯ জন যাত্রী নিয়ে দিল্লিতে অবতরণ করেছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। বিমান থেকে নামার পরই সাংবাদিকদের সামনে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন এক আফগান তরুণী। কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছেন তিনি আফগানিস্তান থেকে। কিন্তু তাঁর বন্ধু, পরিবার কারোরই আর সেই সুযোগ হয়নি। এক নিঃশ্বাসে সেই আফগান তরুণী বলে ফেলেছিলেন, ‘ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে। মেয়েদের আর কোনো অধিকার থাকবে না।’

বিগত একসপ্তাহ ধরে ক্রমাগত নিজেদের ক্ষমতার পরিধি বাড়িয়ে চলেছিল তালিবানরা। একটু একটু করে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিল আফগানিস্তান প্রশাসন। কিন্তু কোথাও যেন আশার আলো ধরে রেখেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গতকাল তালিবানদের কাবুল দখলের পর সবকিছুই তলিয়ে গেল অন্ধকার অনিশ্চয়তার মধ্যে। 

২০০১ সাল। ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সঙ্গে দীর্ঘযুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত সিংহাসন ছেড়েছিল তালিবানরা। তারপর ২০০২ সালের ১৮ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয়েছিল আফগান সরকার। ক্ষতবিক্ষত কাবুলও যেন সেজে উঠেছিল সেদিন। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, সেদিনের উদযাপনে নারীদের উপস্থিতি। দীর্ঘ এক দশক পরে বাড়ির বাইরে সেই প্রথম পা রেখেছিলেন তাঁরা। সে যেন এক অন্য মুক্তি। 

না, তারপরেও যুদ্ধ থেমে থাকেনি তালিবানদের সঙ্গে। তবে ধীরে ধীরে চরিত্র বদলেছিল আফগানিস্তানের। বোরখা পরার বাধ্যবাধকতা কমেছিল। মহিলাদের জন্য খুলে গিয়েছিল স্কুল, কলেজের দরজা। খুলেছিল জিম। সাম্প্রতিক সময়েও মহিলাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল না ঠিকই, তবে সেই অধিকারের লড়াই করার জায়গাটুকু অন্তত দিয়েছিল আফগান সরকার। বিবিসি’র সাক্ষাৎকারে আফগান শিক্ষিকা এবং মানবাধিকার কর্মী পশতানা দুরানির কথায় ফুটে উঠল বাস্তব পরিস্থিতির কথা। পশতানা জানাচ্ছেন, তালিবান রাজত্ব মহিলাদের দাবিটুকুও শুনতে ইচ্ছুক নয়। সেখানে যেকোনো আবেদনেরই পরিণতি মৃত্যুদণ্ড। গোপন আস্তানা থেকে ইন্টারনেটে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় যেন শিউরে উঠছিলেন তিনি। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাউকে না কাউকে যে কথা বলতেই হবে। 

আরও পড়ুন
তালিবানি আগ্রাসনের মধ্যেই শান্তির স্বপ্নে বুঁদ আফগানিস্তানের মহিলা সাংবাদিক

পশতানার কথায় উঠে আসছিল আফগানিস্তানের ছাত্রীদের পরিস্থিতিও। কাবুল দখলের আগে থেকেই আফগানিস্তানের একাধিক প্রদেশে ছাত্রীদের বাড়ি ফেরার জন্য জারি করা হয়েছিল আপদকালীন নোটিস। কিন্তু ফিরবেন কীভাবে তাঁরা? ট্যাক্সিচালকও যে অস্বীকার করছে বোরখা না পরা কোনো মহিলাকে গাড়িতে তুলতে। তার জন্য যে তাঁকেও প্রাণ দিতে হতে পারে। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০ বছর তরুণী জানাচ্ছেন এমনটাই। তৃতীয় বর্ষের সেই ছাত্রীটি একইসঙ্গে দুটি কোর্স করছিলেন আফগানিস্তানের ভিন্ন ভিন্ন দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু দোরগোড়ায় এসেও শেষ হয়ে উঠল না তাঁর স্নাতকতা। আর স্পষ্ট ভাষাতেই তিনি জানাচ্ছেন, আর কোনোদিন কলেজে ফেরা সম্ভব হবে না তাঁর। 

আরও পড়ুন
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই মৌলবাদী আক্রমণ? আশঙ্কায় আফগান মহিলারা

একই ছবি আফগানিস্তানের সরকারি অফিসগুলিতেও। আফগানিস্তানের সর্বকনিষ্ঠ মহিলা মেয়র জারিফা গাফারি আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছেন। না, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাননি জারিফা। দীর্ঘদিন মহিলাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে আসা ২৮ বছর বয়সী তরুণী জানাচ্ছেন, এক নিমেষেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল এতদিনের পরিশ্রম। তিনি তো বটেই, সুরক্ষিত নন অফিসের কর্মরত যেকোনো মহিলাই। জারিফা নিশ্চিত তাঁর ‘বৈপ্লবিক’ কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর অবস্থান খুঁজে খুন করবে তালিবানরা। কিন্তু তারপরেও পালিয়ে যেতে নারাজ তিনি। 

আরও পড়ুন
ভ্যাকসিন দিতে কেন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী? গুলিতে ঝাঁঝরা তিন আফগান মহিলা

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের, ষাট সত্তর দশকেও আফগানিস্তানের চেহারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেসময় কাবুলের পথে স্কার্ট পরিহিত মহিলাদের ছবি দেখলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তারপর তালিবানরাজ আগমনের পরে পাল্টে গিয়েছিল গোটা ছবিটা। মহিলারা হয়ে উঠেছিল সমাজের দাস, পণ। স্বাধীনতা তো দূরের কথা, শারীরিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হলেও, সঙ্গে থাকতে হত পুরুষ সঙ্গী। নাহলেই প্রাণ দিতে হত আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে। সম্প্রতি, তালিবানদের কাবুল দখলের পর হঠাৎ করেই যেন ফিরে এল সেই অন্ধকার যুগ। এখন শুধুই ছড়িয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। আফগান মহিলাদের আকাশ থেকে এই কালো মেঘ কবে কাটবে, তা জানা নেই কারোরই…

Powered by Froala Editor