কৃষিপ্রধান দেশ ভারত, অথচ দুর্ভিক্ষ বারবার থাবা বসিয়েছে মানুষের জীবনে। স্বাধীনতার পরেও খাদ্যসংকটের মতো সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই চলেছে দীর্ঘদিন। অবশেষে ছয়ের দশকের শেষভাগে ভারত সরকার নিয়ে আসে ‘সবুজ বিপ্লব’ (Green Revolution)। যার উদ্দেশ্য ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যশস্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভারতকে কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রদান করা। এই পরিকল্পনার মূল্য উদ্যোক্তা ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথন (MS Swaminathan)। পরবর্তীতে এর সাফল্য ও বিস্তৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তাঁকেই বলা হয় ভারতের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর জনক। আজ চেন্নাইয়ে নিজের বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর।
১৯২৫ সালে চেন্নাইয়ের তাঞ্জাভুর জেলায় এম এস স্বামীনাথনের জন্ম। পুরো নাম মানকম্বু সাম্বাশিভন স্বামীনাথন। পিতা ছিলেন চিকিৎসক। খুব কমবয়স থেকেই কৃষিবিদ্যার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। বাংলার ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ গভীর ছাপ ফেলেছিল মনে। তামিলনাড়ু অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে চলে আসেন দিল্লিতে। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (Indian Agricultural Research Institute) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। দেশে ফিরে যুক্ত হন একাধিক গবেষণা সংস্থার সঙ্গে। ভারত সরকারের কৃষি গবেষণার সচিবও ছিলেন স্বামীনাথন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চের প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব বহন করেন। কর্মজীবন থেকে অবসরের পরেও যুক্ত থেকেছেন বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শদাতা হিসেবে।
ছয়ের দশকের শেষ দিকে ভারত সরকারের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর পরিকল্পনায় যুক্ত হন স্বামীনাথন। কৃষিতে বিপ্লবের ধারণাটি এর আগে প্রয়োগ করেছিলেন আমেরিকান কৃষিবিজ্ঞানী নরম্যান বোরলাউগ (Norman Borlaug)। ভারতে স্বামীনাথনের নেতৃত্বে কৃষিক্ষেত্রে উন্নত সরঞ্জাম, উচ্চ ফলনশীল বীজ, কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। আমূল পরিবর্তন ঘটে দেশের কৃষিক্ষেত্রে। বিশেষ করে পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে তার সুফল দেখা দেয়। ফলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে অতি দ্রুত হারে। অবশ্য পথটা মসৃণ ছিল না একেবারেই। বাধা এসেছে অনেক। বিরাট দেশের কোটি কোটি মানুষকে নতুন পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত করানোও ছিল মুশকিলের কাজ। আবার, সবুজ বিপ্লবের সাফল্য নিয়ে বিতর্কও আছে অনেক। সেসব সত্ত্বেও কৃষিক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার জন্য বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন স্বামীনাথন।
১৯৭১ সালে তিনি পেয়েছে র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, যাকে বলা হয় এশিয়ার নোবেল। ১৯৮৬-তে পান অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নামাঙ্কিত সম্মান। পরের বছর কৃষিক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য বিশ্বের প্রথম খাদ্য পুরস্কারের সম্মান অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে ‘টাইম’ পত্রিকার বিচার অনুযায়ী তিনি এশিয়ার ২০ জন সবচেয়ে ‘প্রভাবশালী’ মানুষদের তালিকায় ছিলেন। এই তালিকার অন্য দু’জন ভারতীয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী। রাজ্যসভায় মনোনীত হয়েছেন দু’বার। চেন্নাইয়ে নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি গবেষণা সংস্থা।
তাঁর তিন কন্যাই বিভিন্ন শাখায় নিজেদের নাম সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্ত্রী মীনা স্বামীনাথন কাজ করেছেন ‘ইউনেসকো’-র শিশুবিকাশ ও শিক্ষাবিস্তারের প্রকল্পে। দেশের শিশুশিক্ষার পদ্ধতি নিয়েও ছিল তাঁর দীর্ঘ গবেষণা। দুজনের আলাপ হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন। গত বছর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মীনা। বছর ঘুরতেই প্রয়াত হলেন এম এস স্বামীনাথনও। আজীবন যুক্ত থেকেছেন কৃষিবিদ্যার সঙ্গে। দেশের উন্নতিকল্পে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অবশেষে তাঁর মৃত্যুতে সমাপ্ত হল ভারতের কৃষিবিজ্ঞান চর্চার একটা পর্ব...
Powered by Froala Editor