“আমি যখন অভিনয় করি, যখন কোনো চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি, তখন সেই চরিত্রটার অবস্থানই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার যৌন প্রবৃত্তি বা সাজপোশাকটা মুখ্য নয়।” বলছিলেন অভিনেতা, বাচিকশিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাই এ-কথা স্বীকার করতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই যে পর্দায় অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যেও তিনি নিজের ব্যক্তিগত রুচিবোধের একটা প্রকাশ ঘটিয়েছেন বারবার। বলা যায় সেটাই তাঁর বিশেষত্ব।
বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে যখন লিঙ্গ রাজনীতি নিয়ে নানারকম ভাবনাচিন্তা চলছে, তখন সাজপোশাকের ভিতর দিয়ে 'নারী-পুরুষ' মেরুকরণকে ভেঙে ফেলার একটা প্রয়াসও উঠে এসেছে নানাভাবে। দর্শকদের সামনে সেই ভাবনাচিন্তাকেই একভাবে হাজির করেছেন সুজয়প্রসাদ। বলা বাহুল্য, বৃহৎ অংশের দর্শক সেই আবেদনকে গ্রহণও করেছেন। ব্যক্তিগত রুচিবোধের সীমান্ত পেরিয়ে এবার সেইসব প্রসাধনী সরঞ্জামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন তিনি।
সুজয়প্রসাদ জানালেন, “বিগত ২ বছর ধরে আমি এবং দেবযানী (অভিনেত্রী দেবযানী চট্টোপাধ্যায়) ‘পরব’ নামের এই বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছি। প্রদর্শনীতে থেকেছে আমার ডিজাইন করা কিছু গয়না এবং দেবযানীর ডিজাইন করা পোশাক।” আর দুর্গাপুজোর কিছুদিন আগেই আবারও সেই আয়োজন নিয়ে হাজির হলেন তাঁরা। আগামী ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর মহানির্বাণ রোডের উপর টি-ও-গ্রাফি ক্যাফেতে নতুন করে ফিরছে ‘পরব’।
এবারের প্রদর্শনীতে অবশ্য বেশ কিছু নতুন ধরণের পোশাক ও গয়নার সম্ভার থাকছে, জানালেন সুজয়প্রসাদ। এতদিন মূলত সেরামিকসের গয়নার উপরেই কাজ করেছেন তিনি। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে কাঠের গয়নাও। আর সেই গয়নার নকশা তৈরিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন চিত্রকর শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী। কাঠের গয়নার উপরে তিনি এঁকেছেন বাংলার চিরাচরিত লোক-আঙ্গিকের ছবি। আবার বেশ কিছু নকশায় ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্র অনুসারী শিল্প ভাবনাও। দেবযানী চট্টোপাধ্যায়ের ডিজাইন করা পোশাকের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশের শাড়ি তো থাকছেই। সেইসঙ্গে থাকছে নানা ধরণের উত্তরীয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে পড়তে পারবেন এমন ধুতি।
সুজয়প্রসাদ বলছিলেন এই সমস্ত ডিজাইনের পিছনের ভাবনার কথাও। তাঁর কথায়, “পোশাক এবং অলঙ্কার আমার কাছে মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।” ঐতিহাসিকভাবে তার মধ্যে যে লিঙ্গ বিভাজনের রাজনীতির নির্মাণ হয়েছে, তাকে ভেঙে ফেলাই উদ্দেশ্য তাঁর কাছে। তাঁর মতে, পোশাকের কোনো লিঙ্গ হয় না। কোথাও গিয়ে নারী-পুরুষ বিভাজনের বাইরে থাকা মানুষদের জড়িয়ে নেওয়ার ভাবনাও কাজ করে যাচ্ছে এর মধ্যে।
একইভাবে উঠে এল পরিবেশ সচেতনতার কথাও। “পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই সেরামিক এবং কাঠের গয়নাকে বেছে নেওয়া।” বলছিলেন সুজয়প্রসাদ। একইভাবে দেবযানীর শাড়ির ডিজাইনেও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের ভাবনা কাজ করেছে বলে জানালেন তিনি। তাই মেশিন নির্ভর ডিজাইনের পরিবর্তে হাতে তৈরি নকশার উপরেই বারবার জোর দিয়েছেন তাঁরা।
বিগত ২ বছর ধরে এই আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন বহু মানুষ। এমনকি এগিয়ে এসেছেন শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরীর মতো পেশাদার ডিজাইনারও। সুজয়প্রসাদ বলছিলেন, “আমি তো পেশাদার ডিজাইনার নই। আমি আঁকতেও পারি না। আমি শুধু আমার ভাবনার কথাটুকু বলতে পেরেছি। কিন্তু সেগুলো রূপায়ণের ক্ষেত্রে শর্মিষ্ঠার ভূমিকার কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়।” আগামীদিনে তাঁদের এই পোশাক ও অলঙ্কার ভাবনা আরও বহু মানুষকে জুড়ে নিতে পারবে, এমনটাই প্রত্যাশা থেকে যায়। লিঙ্গ বিভাজনের বাইরে বেরিয়ে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের উদযাপনের ভিতর দিয়ে এভাবেই নির্মাণ হোক নতুন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
Powered by Froala Editor