“দাদুকে তো আমরা দেখিনি। বাবাও সেভাবে পাননি তাঁকে। বাবার যখন মাত্র ৩ বছর বয়স, তখন হঠাৎই চলে গেলেন দাদু। ৩ বছরের একটা ছেলের স্মৃতিতে আর কতটুকুই বা থাকবে? তবে এই শারীরিক অনুপস্থিতিটাই একটা অন্য ধরনের উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল। না পাওয়া থেকেই আমরা সবসময় খুঁজেছি মানুষটাকে।” বলছিলেন তৃণাঙ্কুর বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ বিভূতিভূষণের মৃত্যুর ৭০ বছর পরেও পরিবারটা তাঁরই। তিনি থেকে গিয়েছেন গল্পে এবং স্মৃতিতে।
“ঠাকুমাকে অবশ্য আমরা অনেকদিন পর্যন্ত পেয়েছি। তাঁর স্মৃতিও দুর্বল হয়নি। দাদুর নানা স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে ছিলেন শেষ পর্যন্ত।” ছোটোবেলা থেকেই তৃণাঙ্কুরবাবু দেখতেন বিভূতিভূষণের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলছেন রমা দেবী। তবে ছোটো থেকে এই পরিচয়টা নিয়ে খুব একটা স্বস্তি বোধ করতেন না তৃণাঙ্কুরবাবু। এটাকে বলার মতো একটা পরিচয় বলেও মনে করতেন না। “বিভূতিভূষণের নাতি শুনলেই সবাই বলত, তাহলে তো দাদুর সব লেখা তোমার পড়া। একটা ক্লাস ফাইভের ছেলেকে এমন প্রশ্ন করলে তো রাগ হবেই। আর দাদুর সব লেখা কি ছোটোদের পড়তে ভালো লাগে? নাকি ছোটোদের জন্য সেসব লেখা লিখেছিলেন তিনি? হ্যাঁ ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মিসমিদের কবচ’ এইসব বইগুলো নিশ্চই পড়া ছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর কেউ দাদুর লেখা পড়তে বললেই না বলতাম। একটা রেসিস্টেন্স জন্ম নিয়েছিল।”
নিজের জীবনের এগিয়ে চলার পথে যেন বারবার বিভূতিভূষণের প্রভাব বুঝতে পেরেছেন তৃণাঙ্কুর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নানা বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহটা যেন পরিবারের সংস্কৃতির মধ্যে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। “ঠাকুমাকে দেখতাম, স্বল্পশিক্ষিতা একজন বৃদ্ধা আশেপাশের সমস্ত গাছের নাম, বিজ্ঞানসম্মত নাম, তাদের পরিচয় সব বলে দিতে পারতেন। এখন তো ইন্টারনেটের দৌলতে কোনোকিছু জানা অতি সহজ। তখন তো তেমন ছিল না। কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়েরই কোনোকিছু জানতে অসুবিধা হয়নি কখনও। আর জানতে জানতেই তো জানার আগ্রহও তৈরি হয়।”
বিভূতিভূষণের নাতি বলেই লিখতে হবে, এমনটা মনে হয়নি তাঁর। নিজের তাগিদেই এগিয়ে এসেছেন সাহিত্যের জগতে। তবে তাঁর আরও একটা পরিচয়, তিনি অলঙ্করণ শিল্পী। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবীর মতো নানা সাহিত্যিকের বই অলঙ্করণ করেছেন তিনি। এমনকি বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের একটি ইংরেজি অনুবাদও অলঙ্করণ করেছেন তিনি। নিজের ঠাকুরদার বই অলঙ্করণ করতে গিয়ে কোনো বাড়তি চাপ কি নিতে হয়নি? “অবশ্যই আলাদা চাপ পড়েছে। একে তো দাদুর বই, অলঙ্করণ খারাপ হলে লোকে বলবে কী! তার উপর আবার আসল বাংলা বইটার অলঙ্করণ করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। তাঁর মতো শিল্পীর কাজের অনুকরণ কী সম্ভব? তবে আমি তাঁর আঁকার ধরণকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলেছি। শংকরকে কাছ থেকে আঁকার চেষ্টাই করিনি। সব মিলিয়ে কাজটা খুব একটা খারাপ লাগেনি আমার। এখন আবার সুযোগ পেলে হয়তো আরও ভালোভাবে করতে পারব। কিন্তু অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদহুলির অলঙ্করন এত খারাপ, তার তুলনায় আমারটা চলে যায়।” বললেন তিনি।
আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে
আজ এত বছর পর ঠাকুরদার সাহিত্য নিয়েই কাজ করতে চাইছেন তৃণাঙ্কুর বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের কাছে তাঁর কাজকে আর্কাইভ করে তুলতে চান তিনি। “এটা কিন্তু এসেছে সাহিত্য পড়তে পড়তেই। অন্যান্য সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে পড়তেই পড়েছি দাদুর লেখাও। আগে বিভূতিভূষণের লেখা পড়ে ফেলতে হবে, এমনটা মনে হয়নি কখনোই। তবে ওই যে, বিভূতিভূষণ শতবার্ষিকীতে বাবাকে যেমন দেখতাম নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে দাদুর কাজের প্রদর্শনী করতে, সেই দায়িত্বটা তো এখনও থেকে যায়। এখন অবশ্য আর নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী করার দরকার হবে না। ইন্টারনেটের দৌলতে সবার কাছে পৌঁছনো তো অনেক সহজ।” ইতিমধ্যে সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছেন। সেপ্টেম্বর মাসে অমর সাহিত্যিকের জন্মদিবসকে মাথায় রেখেই বেশ কিছু ওয়েবিনারের আয়োজন করেছেন। প্রতিটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন তিনি নিজে। ভবিষ্যতে সেই কাজটাই আরও বড়ো স্তরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি।
বিভূতিভূষণ তো আপামর বাঙালির সম্পত্তি। হয়তো তাঁর লেখা নানান বিষয়ে ঘোরাফেরা করেনি, কিন্তু পল্লীগ্রামের যে ছবি তিনি এঁকেছেন তা আজও পাঠককে মুগ্ধ করে। বিষয়বস্তু একমুখী হওয়ার জন্য অবশ্য কথা শুনতে হয়েছিল সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকেও। কালিদাস রায় তখন বলেছিলেন, “…তুমি (বিভূতিভূষণ) দেবীর (সরস্বতীর) নাকছাবিতে যে হিরে বসিয়েছ, তা দেবীর সারা অঙ্গের গয়নার জৌলুসকে ছাপিয়ে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।” সেই উজ্জ্বলতার প্রভাটুকুর সন্ধানই দিয়ে যেতে চান তৃণাঙ্কুর বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সমগ্র কাজের মধ্যে দিয়ে...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
তন্ত্রের মূল গ্রন্থের সঙ্গে মিল নেই তারানাথের গল্পের; আড়ালে কী বলতে চেয়েছেন বিভূতিভূষণ?