গত মাসে, আজকের তারিখেই মুক্তি পেয়েছিল ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান-২’। সেই থেকে আলোচনার শেষ নেই। অধিকাংশ দর্শক-সমালোচকরাই সিরিজিটি পছন্দ করছেন। কিন্তু অনেকেই আবার পছন্দ করছেন না। এবং না করার পেছনে কারণ হিসেবে যে যুক্তিগুলি উঠে আসছে। তার মধ্যে একটা হল, অনেকেই সিরিজটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোপাগান্ডা সিরিজ হিসেবে দেখছেন। সিরিজিটিতে অভিনেতা সীমা বিশ্বাস একজন বাঙালি মহিলা প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে (ম্যাডাম/পিএম বাসু) অভিনয় করেছেন। যাঁর সঙ্গে অনেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাহ্যিক মিল খুঁজে পাচ্ছেন। অনেকেই এতে খুশি হয়েছেন। কিন্তু অনেকেই অখুশি হচ্ছেন। চরিত্রটিকে অত্যন্ত খারাপ ভাবে পোট্রে করার মাধ্যমে নির্মাতারা দেশের জনমানসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেজ খারাপ করার চেষ্টায় রত হয়েছেন বলে তাঁদের অভিমত। যা কিনা গোবলয়ের বহুদিনের কৌশল। বিশেষ করে তামিল তথা দক্ষিণ ভারতীয়দের মনে তাঁর প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। যেখানে বাঙালি তথা অনেক দেশবাসী আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবারের জন্য একজন বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখেছে সেই পরিস্থিতিতে তাঁর ইমেজ খারাপ করে নির্মাতারা বকলমে বিজেপির সুবিধা করে দিচ্ছেন। এই নিয়ে অনেকে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন।
প্রথমেই বলি, আমার মতে যারা 'দ্য ফ্যামিলি ম্যান-২' কে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোপাগান্ডা সিরিজ বা গোবলয়ের বাঙালিবিদ্বেষী মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন, তাঁদের কিছুটা ভুল হচ্ছে। এটা ঠিক যে সিরিজে দেখানো হয়েছে যে তামিলরা পিএম-কে পছন্দ করছেন না। কিন্তু ব্যাপারটা অত সরল নয়। এর জন্য আমাদের কয়েকটা অন্য কিছু অ্যাঙ্গেল থেকে বিষয়টিকে দেখতে হবে। সিরিজটির পরিচালক জুটি রাজ নিদিমরু ও কৃষ্ণ ডিকে দুজনেই দক্ষিণ ভারতীয়। অন্ধ্রপ্রদেশের। ফলে তাদের মধ্যে প্যান সাউথ ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্ট থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। তাঁদের আগের সিনেমাতেও সেটা আছে। ফলে তাঁদের সঙ্গে গোবলয়ের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এবার যদি বলা হয় অর্থের জন্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সিরিজে তারা গোবলয়ের সেন্টিমেন্ট এনেছেন বা আনতে বাধ্য হয়েছেন, তাহলেও সেটা ভুল বলা হবে। কারণ সিরিজিটির প্রথম সিজনে আমরা কাশ্মীরি মুসলমানদের ওপর ভারত সরকারের অত্যাচার, গো-মাংস বহন করার জন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে দুজন নিরীহ মুসলমানের হত্যা, শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে একজন নির্দোষ ছাত্রের হত্যা, তারপর নিজেদের ভুল স্বীকার না করে উলটে সেই মৃত নিরীহ ছাত্রটিকে সন্ত্রাসবাদী দেগে দেওয়া ইত্যাদি দেখানো হয়েছিল। এবং এইভাবেই সিরিজটিতে মোদি সরকার, ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী ও বিজেপি-আরএসএস-এর কিছু কিছু নীতির কড়া সমালোচনা করা হয়েছিল। ফলে পরের সিজনে নির্মাতাদের রাতারাতি সরকারপন্থী হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ, কোনো যুক্তি বা কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন বাঙালি মহিলা প্রধানমন্ত্রী দেখানো হল। এবং কেন তাকে ইগোইস্ট, নার্সিসিস্ট এইসব ভাবে রিপ্রেজেন্ট করা হল। এর কারণ খুঁজতে আমাদের আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে। জানুয়ারি মাসে 'তাণ্ডব' নামক একটা সিরিজ এসেছিল যা নিয়ে বিজেপি প্রচুর বিরোধিতা করেছিল। পরিচালক ও অভিনেতারা বিভিন্ন হুমকির মুখে পড়েছিলেন। বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল। সিরিজে অভিনেতা জিসান আইয়ুব এর মুখ দিয়ে রামকে নিয়ে কিছু ঠাট্টা, তামাশা করানো হয়েছিল আর সেটাই ছিল অনেকের প্রধান রাগের কারণ। একজন মুসলমান অভিনেতা রামকে নিয়ে ঠাট্টা করছে আর তার সঙ্গে পরিচালক মহাশয়ও মুসলমান (আলি আব্বাস জাফর)। এই ব্যাপারগুলো তারা নিতে পারেনি। কিন্তু যেটা তাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল, তা হল, এই সিরিজে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনাও করা হয়েছিল। সিরিজের মুখ্য অভিনেতা সইফ আলি খান যে আসলে নরেন্দ্র মোদিরই প্রতিমূর্তি সেটা তারা বুঝতে পারেনি। না পারার কারণ হল চরিত্রটার বয়স কম, রাজপুত্রের মত দেখতে, বংশ পরম্পরায় রাজনীতি, বাবা প্রধানমন্ত্রী ছিল ইত্যাদি। এগুলো কোনোটাই মোদিজির সাথে যায় না, বরং রাহুল গান্ধীর সঙ্গে চরিত্রটার অনেক মিল আছে। এর এখানেই অডিও-ভিজুয়াল মিডিয়ামের অ্যাম্বিগুইটি লুকিয়ে আছে। সাদা চোখে যেটা দেখা যায় না। সেটা বোঝার জন্য সিরিজের শুরুতেই যেখানে সইফ আলি খানকে হাজির করা হচ্ছে, সেই দৃশ্যটাকে একটু অ্যানালাইজ করছি। সইফ ওরফে সমর প্রতাপ সিং-এর পার্টি ‘জন লোক দল’ লোকসভা ভোটে তিনশোর বেশি সিট পেয়ে সরকার গড়টা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তার বাবা দেবকী নন্দন সিং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন। সইফ তার বাড়ির বড়ো ব্যালকনি থেকে ভক্ত-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন। সমর্থকরা উন্মাদ। ঘরের ভেতর তার বাবা আর বাবার বন্ধু এবং একইসাথে পার্টির অধ্যক্ষ গোপাল দাস মিশ্র এই দুইজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ নিজেদের কথা বলছেন।
অধ্যক্ষ - দেবকী, তোর ছেলে তো তোর থেকেও অনেক এগিয়ে গেল।
বাবা - এগিয়ে তো গেল। কিন্তু দেখ গোপাল, আমরা আমাদের রাজত্বকালে অনেক ভুল কাজ করেছি। করতে হয়েছে। কিন্তু কখনও দেশ ভাঙার কাজ করিনি। ওর হাতে (ছেলের) দেশের শাসনভার চলে এলে ও তো গণতন্ত্রকে শেষ করে দেবে। ওর মুখটা দেখ। ওর চোখে তুই ডিক্টেটরশিপ দেখতে পাচ্ছিস না? (দুজনের ক্লোজ আপ। দুজনেই চিন্তিত।)
আরও পড়ুন
মনোবিদের চরিত্রে অভিনয় থেকে আত্মহত্যা - অলক্ষেই 'গল্প' বুনলেন আসিফ বাসরা?
আর এই সময় সইফ এমন একটা এক্সপ্রেশন দেয় (বাঁকা হাসি) যার থেকে বোঝা যে তার বাবার অ্যানালাইসিসে কোনো ভুল নেই। এবার তিন তিনজন চরিত্রের জায়গায় কিচ্ছুক্ষণের জন্য অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি আর নরেন্দ্র মোদিকে বসান। বাজপেয়ীজি আর আদবানিজি নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। বলছেন যে আমরা ভুল করেছি কিন্তু দেশ ভাঙিনি। কিন্তু মোদি ভবিষ্যতের ডিক্টেটর হয়ে উঠবে, গণতন্ত্রকে হত্যা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর গোটা সিরিজে সমর প্রতাপকে আটকানোও যায়নি। ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন পাপ কাজ সে করেছে। বাবাকে মেরেছেন (গুজরাট গণহত্যার প্রতীকি), কূটচাল চেলে প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়া অধ্যক্ষর হাত-পা বেঁধে দিয়েছেন। (আদবানিজি বিজেপির যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৪ তে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর তাকে কোথাও দেখা যায় না। এবং তার পেছনে মোদিজির হাত আছে বলে অনেকে মনে করেন।)।
আরও পড়ুন
ব্যাপক খরায় আক্রান্ত আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল, দেখা দিচ্ছে জল-যুদ্ধের সম্ভাবনাও
এই ব্যাপারটাকেই শিল্প সাহিত্যে রূপক বলা হয়। একবারের জন্যও এদের কারোর নাম নেওয়া হল না কিন্তু সিরিজটা দেখে ডিক্টেটরশিপ কী জিনিস সেটা সম্পর্কে দর্শকের একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। এবং সইফের জায়গায় কাকে বসাতে হবে অর্থাৎ চোখের সামনে তারা এরকম মানুষ হিসেবে কাকে দেখতে পাচ্ছেন, এই দুয়ে-দুয়ে চার তারা করে নিতে পারবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। সেটাই ছিল নির্মাতাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এই ব্যাপারটাই 'দ্য ফামিলি ম্যান ২' তে করা হয়েছে। এখানে বাঙালি মহিলা প্রধানমন্ত্রী চরিত্রের আড়ালে আসলে মোদিজিই আছেন। হিন্দুত্ববাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যিনি কৃতিত্ব নেওয়ার রাজনীতি করেন, দেখনদারিতে বিশ্বাসী, ইগোইস্ট, দেশকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখেন ইত্যাদি। সিরিজে পিএম বাসুর মুখে তামিলদের উদ্দেশ্য করে একটা সংলাপ আছে – “ওদের জন্য আমি কি না করেছি। যখন বন্যা হয়েছিল সবার প্রথম আমি হেলিকপ্টারে করে দেখতে গিয়েছিলাম, টাকা দিয়েছি। তারপরেও ওরা আমাকে এত অপছন্দ করে কেনো। ওদের সব সুবিধা আটকে দিতে হবে...” ইত্যাদি। এবার হেলিকপ্টারে করে বারবার করে বন্যা কবলিত এলাকা-কে পরিদর্শন করেন এবং তার বিরাট প্রচার করেন তা আমরা জানি। সমালোচনা করলে কোন প্রধানমন্ত্রীর ইগোতে লেগে যায় সেটাও আমরা জানি।
আরও পড়ুন
আবার মৃত্যুর ছায়া বলিউডে, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী অভিনেতা আসিফ বাসরা
সিনেমা বা সিরিজ মূলত গল্প বলে। এবং এদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। গল্পটাকে দর্শকের মনোগ্রাহী করতে হয়। এছাড়া সিনেমায় সেন্সর থাকে। যার ফলে যা ইচ্ছে দেখানো বা শোনানো যায় না। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেই নির্মাতাদের বাস্তবতা-কে দেখাতে হয়। এটা খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেল নয়। ফলে অনেক কিছু রূপকার্থে করতে হয়। একধরনের অ্যাম্বিগুইটি তৈরি করতে হয়। এটাই শিল্পের বৈশিষ্ট্য। আমাদের আরেকটা জিনিস মনে থাকবে যে ‘তাণ্ডব’এর পরেই কেন্দ্রীয় সরকার সিরিজের ওপর সেন্সর লাগানোর ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সিরিজগুলি যাতে কোনো ভাবেই সরকারের সমালোচনা করতে না পারে সেটা সেন্সরের মাধ্যমে নিশ্চিত করা। সিনেমায় যেটা আগেই আছে। এসব মাথায় রেখেই নির্মাতাদের এই সিরিজটি বানাতে হয়েছে। সরকারের কড়া নজর ছিল এদের ওপর। তার সঙ্গে যে বিভিন্ন থ্রেটও ছিল সেটাও সহজেই অনুমেয়। সেকারণে প্রথম দফায় শুটিং করার পরে তার অনেকটা অংশ ফেলে দিয়ে নতুন ভাবে রিশুটও করতে হয়েছিল সিরিজটি। প্রথমে কথা ছিল এপ্রিল মাসে সিরিজটি রিলিজ করবে। কিন্তু এসবের কারণে সময় মত রিলিজও করানো যায়নি। কী কী ফেলে দিতে হয়েছিল তাও আমরা জানি না। ফলে সিজন-১ এ যেভাবে খুল্লামখুল্লা সরকারের সমালোচনা করা হয়েছিল এটায় সেভাবে করা যায়নি। কিন্তু তারপরেও মন দিয়ে গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে, এর মাধ্যমে একধরনের করুণ রসের সঞ্চার হচ্ছে। যেই বিষাদ দেশবাসীর মনে বিগত কিছু বছর ধরে বিভিন্ন কারণে সঞ্চারিত হয়ে আসছে তারই প্রতিফলন আমরা সিরিজটিতে দেখেতে পাই। আর এটি বাঙালিবিদ্বেষও নয়। সিরিজিটা কখনই কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করে না। বরং একটা ঘটনাকে যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে সেটা বলার চেষ্টা করেছে। আমাদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারটা অতীতে মৃদুমন্দ হাওয়ার মত ছিল কিন্তু একুশের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর থেকে সেই হাওয়ার বেগ বেড়েছে। এবার ২০২৪ অবধি পৌছতে পৌছতে সেই হাওয়া তীব্র ঝড়ে পরিণত হবে কিনা, তার দিকে আমাদের সবারই নজর থাকবে। ‘দ্য ফামিলি ম্যান-২’ সিরিজটি তাতে বাঁধা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়নি বলেই আমার ধারণা। কারণ সিরিজটির দৃশ্যগ্রহণ করা হয়েছে একুশের নির্বাচনের ফল বেরোনোর অনেকটাই আগে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor