বাড়ি না সমুদ্রের ঢেউ? অবাক করে পোল্যান্ডের এই 'পাড়া'টি

পোল্যান্ডের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ গাডানস্ক্‌ (Gdansk) শহর। ঐতিহাসিক স্থাপত্য আর আকর্ষণীয় নৈশজীবনের টানে ভিড় জমে বহু মানুষের। দক্ষিণের সামুদ্রিক বাতাসে প্রকৃতিও সবর্ক্ষণ বেশ ফুরফুরে। তবে শহরের মধ্যেও আছে একটা সমুদ্র। বা বলা যেতে পারে সমুদ্রের তরঙ্গ। শহরের একটি বিশেষ স্থানে গেলেই মিলবে তার দেখা। আসলে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি বাড়ি। কিন্তু এমন অদ্ভুতভাবে তাদের অবস্থান, যেন মনে হবে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়েছে গাডানস্কের বুকে। আর শুধু পোল্যান্ড নয়, সারা ইউরোপের জনবসতিপূর্ণ দীর্ঘতম বাড়ির তকমা রয়েছে এর সঙ্গে।

তার নাম ফ্যালোইয়েক ওয়েভ বিল্ডিং (Faloweic Wave Building)। পোলিশ ভাষায় ‘ফালা’ শব্দের অর্থ তরঙ্গ। বহুবচনে ‘ফ্যালোইয়েস’। প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে টানা বাড়িগুলির অবস্থান। সব মিলিয়ে রয়েছে পাশাপাশি লাগোয়া মোট আটটি বিল্ডিং। উচ্চতায় ১০২ ফুট আর প্রস্থে ৪২ ফুট। ১১ তলায় বিভক্ত সবকটি বাড়ি মিলিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা ১৭৯২। প্রায় ৬০০০ লোকের বসবাস এখানে। এক অর্থে ফ্যালোইয়েক-কে একটা ছোটোখাটো পাড়া বললে ভুল হবে না। কারণ একটি নির্দিষ্ট ঠিকানা নয়, বরং চারটি আলাদা ঠিকানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো বিল্ডিংটি। তিনটি বাস স্টপ আর একটি রেল স্টেশনের ব্যবস্থাও আছে অধিবাসীদের জন্য। 

সমগ্র গাডানস্কের আবহাওয়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বাড়িগুলি। দক্ষিণের সমুদ্রের আর্দ্র বাতাস প্রথম ধাক্কা দেয় ফ্যালোইয়েক-এ। ফলে এই অংশের বাসিন্দারা অভ্যস্ত উষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে। আবার উত্তর দিকের বাসিন্দারা সারা বছর শীতল অংশের নাগরিক। যদিও এই বিল্ডিংয়ের বর্তমান সময়ে কোনো অস্তিত্ব থাকারই কথা ছিল না। এটা ছিল নেহাতই সাময়িক। কাজ ফুরিয়ে গেলে কথা ছিল ভেঙে ফেলার। কিন্তু ঘটল অন্যরকম।

আসলে ১৯৬০-এর সময়ে গাডানস্কে দেখা দেয় বাসস্থানের সংকট। সেই সমস্যার সমাধানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল ওয়েভ বিল্ডিং-টিকে। অনুমান করা হয়েছিল প্রায় এক দশকের কাছাকাছি সময় প্রয়োজন এটি বানাতে। কিন্তু ১৯৭০-৭৩ এই সময়ের মধ্যেই প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলা হয় কাজটি। পশ্চিমদিকের কয়েকটি বাড়ির কাজ অর্ধেক হতেই শহরবাসী দখল করে নেয় সেই অংশগুলি। ফলে দ্রুততার সঙ্গে বানাতে হয় অন্য দিকটি। লোকজনদের সেদিকে পাঠিয়ে শেষ করা হয় অন্য অংশের কাজ। দূরে দেখা যায় সমুদ্র, চমৎকার আবহাওয়া, দামও বেশি নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা ‘সমুদ্রবাড়ি’-তে থাকার মজা। পরবর্তীতে বাসস্থানের সমস্যা খানিক মিটলেও এখান থেকে নড়তে চাইলেন না তারা। 

আরও পড়ুন
ছাদ নিচে, মেঝে শূন্যে ভাসমান— বিশ্বের কিছু ‘উল্টো’ বাড়ির গল্প

কিন্তু কেন ঠিক এরকম আকৃতির বাড়িই তৈরি করতে হল? প্রথমে কিন্তু পরিকল্পনা ছিল সাধারণ আকৃতিতেই নির্মিত হবে ফ্যালোইয়েক। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল সেভাবেই। আটটি বাড়ি তৈরির কথাও ছিল না। কিন্তু জনতার ভিড় এতোটাই বেড়ে গেল যে সমস্ত পরিকল্পনা আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। ফলে স্থান বাড়ানোর জন্যই সমুদ্রের তরঙ্গের মতো করে গড়ে তুলতে হল বিল্ডিং-টি। 

আরও পড়ুন
উল্টে রয়েছে আস্ত বাড়ি! কারা থাকেন এখানে?

এই ধরনের নির্মাণ অবশ্য পোল্যান্ডে একেবারে নতুন কিছু নয়। অন্য শহরেও আছে এরকম ‘ওয়েভ বিল্ডিং’। তবে সেগুলি গাডানস্কের মতো এত দীর্ঘ নয়। ইউরোপে একমাত্র অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ‘কার্ল-মার্ক্স-হফ বিল্ডিং’-ই কিছুটা টক্কর দিতে পারে এই বাড়িটির সঙ্গে। ইতিহাসের দিক থেকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ ভিয়েনার বাড়িটি। কিন্তু জনসংখ্যায় এগিয়ে থাকবে ‘ফ্যালোইয়েক’। অবশ্য এর প্রতিটি বাড়ি একে-অপরের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ফলে প্রতিবেশীদের মধ্যেও যোগাযোগ নেই নিয়মিত। শুধু হয়তো দক্ষিণের সমদ্রে সূর্যাস্ত দেখার জন্য ব্যালকনিতে বসলে মিলতে পারে দেখা। উত্তরের লোকেরা আবার সে সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত।

Powered by Froala Editor