“দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার তথা দেশের নানা প্রান্তে লোকঠকানোর ব্যবসা চলছে পুরনো মুদ্রাকে ঘিরে। ইতিহাসের প্রতি মানুষের একটা দুর্বলতা রয়েছে। আর তাকেই কাজে লাগাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।” বলছিলেন সুন্দরবনের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক উজ্জ্বল সরদার। আজ সকালে বারুইপুর বৈষ্ণবপাড়া এলাকায় এমনই এক বিক্রেতাকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি।
মাঝে মাঝেই আমরা আমাদের আশেপাশে এমন বিক্রেতাদের দেখতে পাই। কেউ নিয়ে আসেন সিপাহী বিদ্রোহের আমলের মুদ্রা, কেউ আবার রাম-সীতার ছবি দেওয়া মুদ্রা। প্রত্যেকেই মোটামুটি একইরকম গল্প শোনান। হয় তাঁর এলাকায় পুকুর কাটতে গিয়ে বা কোনো বাড়ি তৈরির জন্য খননকার্যের মাঝে উঠে এসেছে এইসব মুদ্রা। উজ্জ্বলবাবু বলছিলেন, “আসলে এইসমস্ত মুদ্রার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই। খুব সম্প্রতি কোনো স্থানীয় লেদ কারখানায় তৈরি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের হাতে পড়লেই তা ধরা পড়ে যাবে। আর তাই সাধারণ মানুষকেই বোকা বানাতে চান তাঁরা।”
উজ্জ্বলবাবু নিজেও একজন সংগ্রাহক। নানারকমের ঐতিহাসিক নমুনা সংগ্রহ করার বাতিক রয়েছে তাঁর। আর তাই আজ সকালে এক বন্ধু তাঁকে এই বিক্রেতার খবর দেন। খবরটি শুনেই উজ্জ্বলবাবু প্রকৃত বিষয়টি আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার পথ পৌঁছানোর আগেই সেই বিক্রেতা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বাজারের মধ্যে অন্য এক ব্যক্তিকে মুদ্রা বিক্রির চেষ্টা করে সেই ব্যক্তি। আর তখনই উজ্জ্বলবাবু তাঁকে হাতেনাতে পাকড়াও করেন। উজ্জ্বলবাবু খবর পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে হাজির হয় বারুইপুর পুলিশের একটি দল। এর আগে ২০১৯ সালে শাসন থেকে এমনই এক প্রতারককে ধরিয়ে দিয়েছিলেন উজ্জ্বলবাবু।
তবে প্রশাসনের ভূমিকার চেয়েও এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতাই অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন তিনি। এই সচেতনতা গড়ে তোলার কাজে কিছুদিন আগেই বীরভূম প্রশাসন থেকে ‘মুদ্রারাক্ষস’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়। সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে সেই তথ্যচিত্র। এমন উদ্যোগ আরও বেশি বেশি করে গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন উজ্জ্বলবাবু। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর আবেদন, তাঁরা যেন এইসব প্রতারকের ফাঁদে পা না দেন। ভারতের প্রত্নসামগ্রী আইন অনুযায়ী ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে এমন যে কোনো জিনিস খোলাবাজারে বিক্রি করা বে-আইনি। আর তাই মুদ্রা সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা ভারতীয় ট্যাঁকশালের উপরেই ভরসা রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি যদি সত্যিই কোথাও খননকার্যের মাধ্যমে কোনো প্রত্নসামগ্রী উঠে আসে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের নজরে আনা প্রয়োজন বিষয়টি, এমনটাই জানালেন উজ্জ্বলবাবু। কেউ ব্যক্তিগত সংগ্রহে কোনোকিছু রাখতে চাইলেও ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থার তালিকায় তা নথিভুক্ত করে রাখা প্রয়োজন।
হয়তো একজন বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে সমস্যার কোনো সমাধানই হবে না। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর ভিতর দিয়েই যদি সচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে দীর্ঘদিনের জালিয়াতি ব্যবসার অবসান ঘটানো সম্ভব।
চিত্রঋণ - উজ্জ্বল সরদার
Powered by Froala Editor