ভারতের একমাত্র মহিলা ‘নবাব’ বাংলার ফৈজুন্নেসা

মহাবিদ্রোহের পর কেটে গিয়েছে প্রায় দুই দশক। বাংলায় এমনিতেই বিদ্রোহের প্রভাব তেমন পড়েনি। কিন্তু তা হলে কী হবে? ব্রিটিশ শক্তির বিপন্নতার সুযোগ নিয়ে প্রায় সব জমিদারই খাজনা ফাঁকি দিতে শুরু করেছে। ঠিক এই সময়েই হঠাৎ অবাক হলেন ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস। একটিমাত্র জমিদারি থেকে সম্পূর্ণ কর আদায় হয়েছে। হিসাবে একচুল গণ্ডগোল নেই। কুমিল্লার উত্তরে ছোট্ট জমিদারি লাকসাম (Laksam)। সেখানে সদ্য জমিদারির দায়িত্ব নিয়েছেন ফইজুন্নেসা চৌধুরানী (Faizunnesa Chowdhurani)। তিনিই পাঠিয়েছেন এই খাজনা। তবে বিষয়টা পুরোপুরি যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য নয়, সেটা বোঝা গেল কিছুদিনের মধ্যেই। আর তারপর ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তদবির করলেন, ফৈজুন্নেসাকে নবাব উপাধি দেওয়া হোক।

মোঘল আমলের নবাবি প্রথা শেষ হয়ে গেলেও বাছাই করা কিছু জমিদারদের নবাব উপাধি দিত ব্রিটিশ সরকার। হিন্দু জমিদারদের ক্ষেত্রে মহারাজ, আর মুসলমান জমিদারদের ক্ষেত্রে নবাব। এটাই জমিদারির সর্বোচ্চ সম্মান হিসাবে বিবেচিত হত। ফৈজুন্নেসাকে নবাব উপাধি দেওয়া নিয়ে কিন্তু বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে নয়, বিতর্ক শুরু হল বাংলার মুসলমান সমাজের মধ্যেই। কারণ তিনি যে একজন মহিলা। মহিলাদের কী করে নবাব উপাধি দেওয়া যেতে পারে? শেষে মহারানি ভিক্টোরিয়া ঠিক করলেন, তাঁকে বেগম উপাধি দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ফৈজুন্নেসা। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, প্রজারা তাঁকে বেগম বলেই ডাকেন। কিন্তু তিনি এমন সম্মান চান, যা একজন পুরুষের সমকক্ষ। মহিলা বলেই পিছিয়ে থাকতে রাজি নন তিনি।

শেষ পর্যন্ত ফৈজুন্নেসার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছিল সকলকেই। ১৮৮৪ সালে ইংল্যান্ডে রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে নবাব উপাধি দিতে বাধ্য হলেন। নবাব ফৈজুন্নেসা, ভারতের ইতিহাসে একমাত্র মহিলা নবাব। ১৮৩৪ সালে তৈমুরী মুসলমান পরিবারে জন্ম তাঁর। ছোটো থেকেই অভিজাত মুসলমান পরিবারের রীতি মেনে পর্দার আড়ালে তাঁর বেড়ে ওঠা। তবে বাবা আহমদ আলি চৌধুরী ছিলেন মুক্তমনের মানুষ। তাই তাঁর দুই মেয়ের জন্য বাড়িতেই প্রাইভেট শিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। আরবি এবং ফারসি ভাষা দিয়েই শিক্ষা শুরু। তবে ক্রমশ বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রতিও আকৃষ্ট হন ফৈজুন্নেসা। সেকালে মুসলমান পরিবারের মধ্যে থেকে সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা সত্যিই কঠিন ছিল। বহু আত্মীয় নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু সেইসব কোনো কথাই কানে তোলেননি আহমদ আলি।

এদিকে ইংরেজি ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি সংবাদপত্র পড়তেও শুরু করেছিলেন ফৈজুন্নেসা। সেই সময় ইউরোপের বুকে নানা প্রগতিশীল চিন্তার জন্ম হচ্ছে। সেসবের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন তিনি। তাঁর জন্মের দুবছর আগেই ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভায় প্রথম রাজকীয় সংস্কার আইন পাশ হয়। এতদিন যেখানে শুধুই পুরুষদের ভোটাধিকার ছিল, সেখানে মহিলারাও সমানভাবে প্রশাসনিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। এইসব ঘটনা ফৈজুন্নেসার চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তিনি ভাবতে শুরু করেন, একদিন এই ভারতেও আর নারী-পুরুষে বিভাজন থাকবে না।

আরও পড়ুন
নবাবি কলমে রাধাকৃষ্ণের কিস্‌সা, নর্তকীর বেশে হোলি উদযাপন ওয়াজেদ আলি শাহের

২৭ বছর বয়সে এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ হয় ফৈজুন্নেসার। দুটি সন্তানেরও জন্ম দেন ফৈজুন্নেসা। ততদিনে ব্রাহ্ম সমাজের দৌলতে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অভিজাত মুসলমান পরিবারে বহুবিবাহই ছিল দস্তুর। ফৈজুন্নেসার স্বামীরও এর আগে একটি বিবাহ হয়েছিল। এটাই মেনে নিতে পারেননি তিনি। আর তাই কয়েকমাসের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানান। তারপর থেকে লাকসামের পশ্চিমগাঁও গ্রামে পৈতৃক বাড়িতেই থাকতেন তিনি। এর মধ্যে মহম্মদ আলির মৃত্যু হয়। তারপর ফৈজুন্নেসার মা কিছুদিন জমিদারির দেখাশোনা করেন। ১৯৮৩ সালে জমিদারির দায়িত্ব নিলেন ফৈজুন্নেসা। আর তারপরেই রাণি ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে আদায় করলেন নবাব উপাধি।

আরও পড়ুন
মুঘল সম্রাটের সঙ্গে নির্বাসনে তাঁর বেগমও, রেঙ্গুনেই কাটালেন শেষ ২৮ বছর

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নবাব ফৈজুন্নেসা। তিনি নিজে জমিদারির দায়িত্ব নেওয়ার আগেই, ১৮৭৩ সালে গড়ে তুলেছিলেন কুমিল্লা বালিকা বিদ্যালয়। এরপর পশ্চিমগাঁওতেও একটি স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের একসঙ্গে বসে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন। বর্তমানে সেই স্কুল নবাব ফৈজুন্নেসা স্মৃতি কলেজ হিসাবে পরিচিত। শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও বৈষম্যের শিকার হতেন মহিলারা। তাই তাঁদের জন্য প্রথমে একটি দাতব্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পরে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালও তৈরি করেছিলেন তিনি। উনিশ শতকের শেষদিকে ভারতজুড়ে যে নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন নবাব ফৈজুন্নেসা। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতির আড়ালে তাঁর সমস্ত কীর্তি ও জীবন হারিয়েই গিয়েছে শেষ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
১৩ বছর বয়সেই ‘দিওয়ানা’ করেছেন দেশকে, আজও গজলের সঙ্গে সমার্থক তাঁর নাম

Powered by Froala Editor

More From Author See More