সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার তুলনায় লেখালিখি নিয়ে আলোচনা কি কোথাও পিছিয়ে পড়ে? অথচ, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান নেহাত কম নয়! গোয়েন্দা, কল্পবিজ্ঞান, ভূতুড়ে গল্পের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) হাত পাকিয়েছিলেন রূপকথাতেও। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মোট চারটি রূপকথার গল্প লিখেছিলেন তিনি। কাল অনুসারে সাজালে সেগুলো হচ্ছে...
১. 'কানাইয়ের কথা' (সন্দেশ, ফাল্গুন-চৈত্র, ১৩৯২ বঙ্গাব্দ)।
২. 'রতন আর লক্ষ্মী' (নীলকমল লালকমল, ফাল্গুন ১৩৯২ বঙ্গাব্দ)।
৩. 'গঙ্গারামের কপাল' (আনন্দমেলা, বৈশাখ ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ)।
৪. 'সুজন হরবোলা' (সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ)।
এই চারটে গল্পেই একখানা সাধারণ মোটিফ আছে— দুর্ভাগ্য থেকে সৌভাগ্যে উত্তরণ। এই সবকটি গল্পই সাধারণ মানুষ থেকে রাজকীয় মানুষ হয়ে ওঠার গল্প, যে যাত্রার সূচনা হয়েছে বিশেষ কোনো অলৌকিক ক্ষমতা, অথবা প্রতিভার বলে।
পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরের গল্প অবলম্বনে সত্যজিত ১৯৬৯ সালে 'গুপী গায়েন বাঘা বায়েন' ছায়াছবিটি তৈরি করলেন। এই ছবিতে দেখি, সাধারণ জনতার প্রতিনিধি গুপী আর বাঘা হঠাৎ করেই ভূতের রাজার বরে পেয়ে যাচ্ছে তিন-তিনটি আশ্চর্য ক্ষমতা। তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে তারা সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রুখে দিচ্ছে দুই রাজ্যের মধ্যেকার যুদ্ধ, দুই রাজা খুশি হয়ে তাদের বিয়ে দিচ্ছেন রাজকন্যাদের সঙ্গে। এইভাবেই দুই হতমান শিল্পীর দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবন হয়ে উঠছে রাজকীয় জীবন। নিন্দিত জীবন থেকে নন্দিত জীবনে উত্তরণের এই মোটিফ ঘুরেফিরে এসেছে সত্যজিতের প্রতিটি রূপকথার গল্পে। তাঁর রূপকথার নায়কেরা সকলেই গ্রামের মানুষ, খুব যে স্বচ্ছল অবস্থার মানুষ, তাও নয়। লেখকের নিজের আঁকা ইলাস্ট্রেশনেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ওদের। কানাই, রতন, গঙ্গারাম আর সুজন— ওরা সকলে পরে আছে খাটো ধুতি, হাফ-হাতা জামা। ওদের কারোর পায়ে জুতো নেই। কিন্তু, অসামান্য কীর্তিবলে তারা পৌঁছে যাচ্ছে রাজদরবারে, এবং হয়ে উঠছে রাজমন্ত্রী, কিংবা রাজার জামাই।
উপেন্দ্রকিশোরের মতো সত্যজিতের রূপকথাতেও ফুটেছে ভারতের প্রাগাধুনিক সভ্যতার ছবি, এসেছে দেশীয় রাজতন্ত্র, এসেছে অতিলৌকিক উপাদান। তবে তফাত এই যে, উপেন্দ্রকিশোরের রচনায় যেমন পাতায় পাতায় কৌতুকরসের ছড়াছড়ি, সত্যজিতের লেখায় তেমনটা নয়৷ সত্যজিতের রূপকথা শুরু থেকে শেষ অবধি বেজায় 'সিরিয়াস'!
রায়বাবুর প্রথম রূপকথা-কাহিনি 'কানাইয়ের কথা'-র সঙ্গে তাঁর 'হীরক রাজার দেশে' (১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছায়াছবিটির বিস্তর মিল। এই গল্পেও কানাই 'জটাই বাবা' নামক এক ঋষিপ্রতিম বৃদ্ধের দয়ায় তিনটি জাদুশক্তি লাভ করে। লাল, নীল আর হলদে— তিনটি ফল খেয়ে সে পেল অস্বাভাবিক দ্রুতগতি, অদৃশ্য হওয়ার বিদ্যে, আর মন্ত্রিত্ব করার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি। এইসব ক্ষমতা দিয়েই সে নিজের বাবাকে তো বটেই, 'চাঁদনি' গাছের পাতা বিলিয়ে রূপসার প্রজাসাধারণের সব্বাইকে 'শুখনাই' রোগের মড়ক থেকে রক্ষা করল। শুধু তাই নয়, রূপসার স্বৈরাচারী রাজাকেও ক্ষমতাচ্যুত করল, এনে দিল উজ্জ্বল নবযুগের সূচনা।
'হীরক রাজার দেশে' ছায়াছবির শেষদিকে একটা বড়োসড়ো প্রশ্নচিহ্ন ছিল। সত্যজিৎ স্বৈরাচারীর পতন দেখালেন, কিন্তু রাজ্যের তাৎক্ষণিক ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বললেন না। এই গল্পে সেই ‘লুপ হোল’ মেরামত করা হয়েছে। কানাইয়ের সাহায্যে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে রূপসার উদারচিত্ত রাজকুমার কিশোর, আর অত্যাচারী রাজার সিংহাসন-ত্যাগের পর রাজ্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে কিশোরই হয়েছে নতুন রাজা। আর কানাই? সে হয়েছে কিশোরের প্রধান মন্ত্রী!
পরের গল্প 'রতন আর লক্ষ্মী'। এ গল্পে এক তান্ত্রিক সাধুবাবার অভিশাপে নায়ক রতন রাক্ষসে পরিণত হয়, তার দেহে আসে অমিত শক্তি, সেই সাথে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে যায়। নরভুক দানবকে বধ করে সে গান শুনিয়ে রাজকন্যা লক্ষ্মীর মনোহরণ করে। লক্ষ্মীর রতনকে বিবাহের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে সাধুবাবার শাপমোচন— রতন আবার ফিরে পায় তার পূর্বরূপ!
তিন নম্বর গল্পের নায়ক হচ্ছে গঙ্গারাম, গল্পের নাম 'গঙ্গারামের কপাল'। সৎ স্বভাবের সাদাসিধে এই ছেলেটির হাতে আসে রামধনু-রঙা 'সাতশিরা' পাথর, আর এই জাদু-পাথরের জোরেই শুরু হয় তার আকস্মিক ভাগ্যোন্নতি। কিন্তু যখন জানা যায় পাথরটির আসল মালকিন এক রাজকন্যে, গঙ্গারাম বিনা দ্বিধায় সে পাথর ফেরত দিতে যায়। তার এই নির্লোভ স্বভাব দেখে রাজকন্যা সুনয়না তাকে পাত্র হিসাবে মনোনীত করে। এও একপ্রকার স্বয়ম্বর, সন্দেহ কী!
এই ধারার সবচেয়ে সুলিখিত গল্পটি হচ্ছে চার নং গল্প 'সুজন হরবোলা'। এখানে নায়ক সুজন কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী হয়নি। সে কেবল নিজের ছোটোবেলার স্বপ্নকে ছুঁতে চেয়েছে, আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে ক্রমে হয়ে উঠেছে এক উচ্চমানের হরবোলা। কেবল নিজের প্রতিভায় ক্রমাগত শান দিয়ে সে এক রাজার দাক্ষিণ্য পেয়েছে, পেয়েছে সেই রাজার কন্যাটির বিশেষ মনোযোগ, আর অবশেষে সেই বীর্যশুল্কা রাজকন্যার শর্ত পূরণ করে পাখি-খাদক রাক্ষস বিহঙ্গভুককে বধ করে নিজেকে রাজকন্যার যোগ্যপাত্র হিসাবে প্রমাণ করেছে।
আচ্ছা, ভালো কথা, নায়কদের পাশাপাশি এই সব গল্পের নায়িকাদের নিয়ে একটু কথা না বললে চলে! তাদের মতো স্বাধীনমনস্কা মেয়েদের কথা তো বলতেই হবে!
'গুপী গায়েন বাঘা বায়েন' ছবিতে আমরা দুই রাজকন্যাকে দেখেছিলাম— মণিমালা আর মুক্তামালা। পর্দায় তাদের উপস্থিতি অল্প সময়ের জন্য, এবং সে উপস্থিতি সম্পূর্ণ নির্বাক, সংলাপহীন। তবে তার মধ্যেই দুই কন্যে নিজেদের স্বাতন্ত্্য দেখিয়েছে। বাবাদের তরফ থেকে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা গুপী-বাঘার সামনে মুখের ঘোমটা সরাতে রাজি হয়নি, দুই রাজা অপ্রস্তুত হয়ে বলেছেন, তাঁদের মেয়েরা বড্ডো লাজুক কিনা, তাই আরকী...! তবে আসল কথা গুপী-বাঘা ঠিকই টের পেয়েছিল, তাই তালি বাজিয়ে তারা অঙ্গে চাপাল রাজবেশ, আর রাজকন্যারা অবগুণ্ঠন সরিয়ে তাকাল হবু বরেদের দিকে। এইবার, দুই কনের মুখ দেখে, গুপী-বাঘা বিয়েতে সম্মতি দিল।
ভারতের ঐতিহ্যবাহী বিবাহ-প্রথার বিরুদ্ধে এ হল দুই কন্যার নীরব, কিন্তু প্রখর প্রতিবাদ। প্রথমত, অভিভাবকেরা মেয়েদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা জিজ্ঞাসা না করেই নেহাত পণ্যবস্তুর মতো তাদের যে কারোর হাতে তুলে দেবেন, এই রাজকীয় পুরস্কার-প্রথাটিই তাদের কাছে আপত্তিকর। দ্বিতীয়ত, তাদের হবু বরেরা তাদের বিচার করছিল শারীরিক সৌন্দর্যের নিরিখে, স্পষ্ট বলছিল, মুখ দেখতে না পেলে তারা বিয়েতে রাজি নয়। তারা এই 'অবজেক্টিফিকেশন'-এর বিরুদ্ধেও নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে— যতক্ষণ না গুপি-বাঘা রাজবেশে দর্শন দিয়েছে, তারা তাদের ঘোমটা সরায়নি। যদি আপনি মেয়েদের রূপের নিরিখে তাদের 'জাজ' করেন, তারাও তাহলে আপনাকে আপনার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার নিরিখে মাপজোখ করবেই, এই হচ্ছে এই ছোট্ট দৃশ্যায়নটির অন্তর্গত মর্মকথা। আর, আমরা তো অহরহ দেখতেই পাই, এখনও আমাদের দেশে সম্বন্ধ-ঘটিত বিবাহে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই দুটি মাপজোখই সবচেয়ে জোরালো! এ দেশে আজও রূপ থাকলে পাত্রীর দাম বাড়ে, আর টাকা থাকলে পাত্রের!
কিন্তু, পরে সত্যজিত যখন রূপকথার গপ্পো লিখলেন, তিনি এই ফিল্মের আইডিয়াটিকেও ছাপিয়ে গেলেন।
সত্যজিতের রূপকথার প্রতিটি নায়িকাই রীতিমতো সরব এবং স্বতন্ত্র— লক্ষ্মী, সুনয়না, শ্রীমতী— সব্বাই! 'রতন আর লক্ষ্মী' গল্পে রাজকন্যা লক্ষ্মী জেদ করে অন্দরমহলের পর্দাপ্রথা ছেড়ে মেলা দেখতে বেরোয়, আর সেই মেলাতেই ঘটে নায়ক-নায়িকার প্রথম চারি চক্ষে মিলন। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে লক্ষ্মী রাক্ষসবেশী রতনের অপূর্ব সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়, এবং দৃঢ়ভাবে পিতা-মহারাজকে জানায়, বিয়ে করতে হলে সে এই গায়ককেই করবে, আর কাউকে না। তার এই সক্রিয়তাই রতনের শাপমোচন ঘটায়, সে আবার রাক্ষস থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে। (সন্ধানী পাঠক, আপনারা 'Beauty and the Beast'-এর ছায়াপাত লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই! রবি ঠাকুরের 'শাপমোচন'-এর কথাও একটু ভেবে দেখা দরকার কিন্তু!) তিন নং গল্পেও দেখি, রাজকন্যা সুনয়না অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসে, আর পিতা-মহারাজের সামনেই দৃপ্ত কণ্ঠে গঙ্গারামকে বিয়ে করার সঙ্কল্প ব্যক্ত করে।
শেষ গল্পের নায়িকা শ্রীমতী এই সিরিজের রমণীকুলের শ্রেষ্ঠ রত্ন। সে ছিল 'অসূর্যম্পশ্যা', আশৈশব অন্দরমহলের বন্দিনী, সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত। কিন্তু উচ্চশিক্ষা তাকে স্বচ্ছ চিন্তা আর দৃঢ় সক্রিয়তার সাহস জুগিয়েছিল। সুজনের প্রতিভামুগ্ধ রাজকন্যা তার সাথে গোপনে সাক্ষাত করে, আর পাখি-খাদক রাক্ষস বিহঙ্গভুককে বধ করার প্ররোচনা দেয়। সে নিজেই ঘোষণা করে, সে হবে বীর্যশুল্কা, বিহঙ্গভুকের নিহন্তাই পাবে তার বরমাল্য।
সুজন যখন এই শর্ত পূরণ করে, বিবাহ স্থির হবার পরেই রাজকন্যা তার হবু বরের বিদ্যাশিক্ষার দায়িত্ব নেয়। আর সুজনের অনুরোধে, নিজেও আরেকটি উজ্জ্বল সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রীমতী ঠিক করে, জেনানা মহলের প্রাচীরের আড়ালে আর নয়, এবার সে হবে মুক্ত। আকাশের পাখির মতোই।
এই তিনটি রাজকন্যাকে গড়ে তুলে রায়বাবু আধুনিক ভারতে নারী-ক্ষমতায়নের ভাবনাটি সূক্ষ্মভাবে জারিয়ে দিয়েছেন তাঁর রূপকথায়। জনতাকে বিনোদন জোগানোর পাশাপাশি কীভাবে জনপ্রিয় শিল্পের মধ্যে বুনে দেওয়া যায় ধীমতী মেধার বার্তা, সে কৌশল সত্যজিতের ভালোই জানা ছিল। তা, তাঁর জন্মশতবর্ষ জুড়ে আনন্দ ও উদযাপনের পর, তাঁর লেখালেখির এসব অল্প-আলোচিত কোণগুলোতেও একটু আলো পড়ুক এবার, কী বলেন?
Powered by Froala Editor