"বঙ্কুবাবু এগোতে লাগলেন। কানের মধ্যে একটা শব্দ আসছে। কিন্তু সেটা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হঠাৎ কানে তালা লাগলে যেমন শব্দ হয়–রী রী রী রী–এ যেন ঠিক সেইরকম।" সত্যজিৎ রায়ের গল্পের এই বর্ণনা তো আমরা সবাই পড়েছি। ক্রেনিয়াস গ্রহের প্রাণী অ্যাং এর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে বঙ্কুবাবু যে শব্দ শুনেছিলেন, তা আজ আর শুধু গল্পের পাতায় নেই। প্রায় তিন দশক জুড়ে তাওসের মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এমনই শব্দ। ঘরের মধ্যে কানে আঙুল দিয়ে বসে বা কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে, কিছুতেই এই শব্দের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না মানুষ।
মেক্সিকোর ছোট্ট শহর তাওস। জুলিয়া রবার্ট, ডেনিস হপার, ডি এইচ লরেন্স, ডোনাল্ড রামসফিল্ডের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে আছে এই শহরকে ঘিরে। এমনিতে আমেরিকার আর পাঁচটা শহরের থেকে আলাদা কিছু নয়। সাজানো-গোছানো, ছিমছাম, মন ভালো করা শহর তাওস। কিন্তু ১৯৯০ সালের শুরু থেকে বেশ কিছু পর্যটক এবং স্থানীয় অধিবাসীরা দাবি করছেন, একটা অদ্ভুত ধরনের গুনগুন শব্দ সারাক্ষণ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে তাওস শহরে। রহস্যময় এই শব্দের নাম দেওয়া হয়েছে 'তাওস হাম'। কিন্তু এই অদ্ভুত শব্দের উৎস কী?
১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে প্রথমবার এই শব্দের কথা জানানো হয় কর্তৃপক্ষকে। ধীরে ধীরে শব্দের উৎপাত এমন বাড়তে থাকে যে স্থানীয় কংগ্রেসেও ব্যাপারটি তুলতে বাধ্য হন তাঁরা। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সমীক্ষা চালানো হয়। শব্দটা যাঁরা শুনতে পান বলে দাবি করেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। শব্দের উৎস খুঁজতে শহরে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি বসানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতে থাকল পেনসিল।
ইউনিভার্সিটি অফ নিউ মেক্সিকোর অধ্যাপক জো মুলিনস গবেষণা চালিয়েছেন 'তাওস হাম'এর উৎস সন্ধানে। তিনি জানান, ৪০০ জন বাসিন্দার উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ অদ্ভুত এই শব্দ শুনতে পান। ফলে চিকিৎসকরা অনেকেই একে 'গণমনস্তাত্বিক রোগ' বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু শব্দের শিকার সাধারণ মানুষ এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। সাক্ষাৎকারে এই তথ্যও উঠে এসেছে যে, শব্দ শোনার পর অনেকেরই বমি ভাব, মাথা ধরা বা নাক দিয়ে রক্ত পড়ার মতো সমস্যা দেখা গেছে।
আরও পড়ুন
স্বাধীনতার কাছে তুচ্ছ সবই; পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম এই দেশের বাসিন্দা মাত্র ৬ জন
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোতে প্রথমবার পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রসওয়েলে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউএফও পাওয়া গিয়েছিল বলেও শোনা যায়। তাওসের রহস্যময় শব্দের উৎস সন্ধানে এমনই অনেক কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ।
আরও পড়ুন
সদ্যোজাত যিশুকে দেখতে বেথেলহেমে হাজির এক ভারতীয়?
গবেষকরা অবশ্য বারবার 'অডিটরি হ্যালুসিনেশন' বলেই দাবি করে আসছেন। নিউরোলজিস্ট অলিভ্র স্যাকস তাঁর 'হ্যালুসিনেশন' বইতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাওস হামের শ্রোতারা অনেকেই বাইরে গিয়েও এই শব্দ শুনেছেন বলে তাঁর দাবি। কাজেই একে হ্যালুসিনেশন বলা অমূলক নয়। কিন্তু এত মানুষের একসঙ্গে এরকম হ্যালুসিনেশন কীভাবে হতে পারে, তার ব্যাখ্যা মেলেনি। অবশ্য ব্যাখ্যা করা যায়নি মানেই কোনোকিছু ব্যাখ্যাতীত নয়। কোনোদিন হয়তো পাওয়া যাবে 'তাওস হাম'এর সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ততদিন পৃথিবীর আশ্চর্য ঘটনাগুলোর একটা হয়ে থাকবে 'তাওস হাম'।
আরও পড়ুন
২৫০ বছর আগে বাঙালির পাঞ্চ-হাউসে ‘পচাই মদ’ খেতে আসতেন সাহেবরাও
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিস্মৃতির অতলে শেষ মোঘল রাজকুমার ফিরোজ শাহ, বেগমের মাসোহারা মাত্র পাঁচটাকা