সাহারা মরুভূমির রহস্যময় চোখ – মহাকাশচারীদের ‘ল্যান্ডমার্ক’, নাকি গোপন শহরের ইঙ্গিত?

মরুভূমির মাঝখানে যেন এক টুকরো সমুদ্র অথবা বালুকাময় প্রান্তরে নেমেছে কোনো ভিনগ্রহী যান। নাসার তোলা সাহারা মরুভূমির ছবি দেখলে এক ঝটকায় এমনটাই মনে হওয়ার কথা। তবে একেবারেই তেমনটা নয়। সাহারার অন্যান্য অঞ্চলের মতোই রুক্ষ-শুষ্ক এই অঞ্চল। খানিক পাথুরেও বটে। আর এই প্রাকৃতিক কাঠামোর নাম রিচাট স্ট্রাকচার কিংবা ‘আই অফ দ্য সাহারা’।

১৯৬৫ সালের কথা। পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছিল নাসার মহাকাশযান ‘জেমিনি-৪’। যাত্রী ছিলেন চার মহাকাশচারী। পৃথিবীর বাইরে থেকে ভূত্বকের বেশ কিছু ছবি পাঠান তাঁরা। সেখানেই প্রথম ধরা পড়েছিল এই অদ্ভুত দৃশ্য। মনে হয়েছিল মরুপ্রান্তরে যেন ছড়িয়ে রয়েছে জলের আধার। আর তাই আক্ষরিক অর্থেই নাসার বিজ্ঞানীরা নামকরণ করেছিলেন ‘সাহারার চোখ’। 

সাহারার এই চোখ অবস্থিত মধ্য-পশ্চিম মৌরিটানিয়ার আদরার মালভূমির নিকটবর্তী ওউদানে। অনেকটা উপবৃত্তাকার এই গঠনের গড় ব্যাস প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল চাঁদ কিংবা মঙ্গলের মতো পৃথিবীর একটি ক্র্যাটার ‘আই অফ দ্য সাহারা’। অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের মতোই কোনো ধূমকেতু, উল্কাপাত কিংবা মহাজাগতিক বস্তুর আঘাতে তৈরি হয়েছিল এই বিশাল গহ্বর।

তবে পরবর্তীতে সেই ধারণা থেকে সরে আসেন গবেষকরা। দাবি করেন এই কাঠামোর গঠনের পিছনে রয়েছে টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধিই। সম্ভবত তখনও তৈরি হয়নি সাতটি পৃথক মহাদেশ। ছিল একটিই বিশাল ভূখণ্ড প্যানজিয়া। তবে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা তৈরির সময় ভূগর্ভস্থ পাতগুলি সরে গেলে ফাটল দেখা দিয়েছিল সাহারার বিভিন্ন অংশে। তেমনই একটি ফাঁক থেকেই গলিত লাভা বেরিয়ে এসে জন্ম এই অঞ্চলটির। তবে পুরোপুরি অগ্নুৎপাত হতে না পারায় তরল লাভা জমাট বেঁধে গম্বুজসদৃশ স্তূপ তৈরি করে।

আরও পড়ুন
উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট, কাজাখস্তানের সমুদ্রে জন্ম বিস্ময়কর ‘আইস ভলক্যানো’র

তারপর ক্রমাগত সেই গম্বুজের ক্ষয় হতে হতেই সৃষ্টি হয় আজকের গহ্বরটি। আর সেই কারণেই খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ‘সাহারার চোখ’-এ লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্তর। কোনোটা রিওলাইটিক আগ্নেয় শিলার, কোনোটা গ্যাব্রোস, কার্বনেটাইটস অথবা কিম্বারলাইটসের। প্রথমত আগ্নেয়শিলার স্তরগুলি বিভিন্ন সময়ে ঠান্ডা হওয়ায় এই তারতম্য। অন্যদিকে কোটি কোটি বছর ধরে ক্ষয়ের মাধ্যমেও পরিবর্তন হয়েছে এই শিলাগুলির। তবে এখানেই থেমে নেই গবেষণা। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস সাহারার এই চোখের রহস্য আজও সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার নয়। 

অন্যদিকে একটা মজার বিষয় হল, এই ক্র্যাটার আবিষ্কারের পর থেকে জন্ম নিয়েছিল আরও একটি মিথ। বিজ্ঞান যে কথাই বলুক না কেন, কিছু মানুষের বিশ্বাস এই গর্ত আসলে প্রাগৈতিহাসিক হারিয়ে যাওয়া নগরী ‘আটলান্টা’। প্লেটোর বর্ণিত এই শহরের বর্ণনাতেও আসলে ছিল এই একই ধরণের কাঠামো। মাটি আর জলের সমকেন্দ্রিক বলয়ের উপস্থিতি সেখানেও সৃষ্টি করত নীল রেখার। এই মিথের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই, তা বলাই বাহুল্য। তবে কোনোদিন জনবসতি না থাকলেও ‘আই অফ দ্য সাহারা’ একটি জনপ্রিয় ল্যান্ডমার্ক। না, কোনো সাধারণ যাত্রীদের জন্য নয়। মহাকাশচারীদের জন্য। এই গর্ত দেখেই মহাকাশ থেকে নির্ণিত হয় ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অবস্থান…

আরও পড়ুন
স্মৃতিশক্তির জোরেই ২১০০ অপরাধীকে গ্রেপ্তার, বিস্ময়-মস্তিষ্ক ইংল্যান্ডের পুলিশ অফিসারের

Powered by Froala Editor

Latest News See More