আড়াইশো বছর আগে ‘অবলুপ্ত’ ভাষার পুনর্জন্ম

যুক্তরাজ্যের (UK) দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নওয়ালে (Cornwall) অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম মাউসহোল। হাজার বছরেরও প্রাচীন ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। তবে মজার বিষয় হল, আজ থেকে তিনশো বছর আগেও কথ্যভাষা হিসাবে এই গ্রামে ব্যবহৃত হত না ইংরাজি। বরং, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন এক ভাষা ছিল স্থানীয়দের। কর্নিশ ভাষা (Cornish Language)। সময়ের সঙ্গে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই ভাষাই এবার নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে ভাষাবিদ ও আঞ্চলিক ইতিহাসবিদদের হাত ধরে। 

কর্নওয়ালের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভাষা ব্রিটিশ সংস্কৃতির থেকে বেশ আলাদা। তার কারণ দীর্ঘ সময় এই অঞ্চলটি ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। আর সেই সূত্র ধরেই জন্ম ‘কর্নিশ’-খ্যাত কেলটিক ভাষাটির। ব্রেটন, ওয়েলশ, কুমব্রিক, অ্যাংলো স্যাক্সন এবং রোমান ভাষার মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল এই ভাষা। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে ১৭৭৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যু হয় ‘কর্নিশ’ ভাষার। হ্যাঁ, সে-বছরই মারা গিয়েছিলেন কর্নিশ ভাষার শেষ বক্তা ডলি পেন্ট্রেথ। আজও মাউসহোল গ্রামে গেলে দেখা মিলবে বিবর্ণ গ্রানাইটের তৈরি পাথর ফলকে খোদাই করা তাঁর এপিটাফ। যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত, তিনিই কর্নিশ-এর শেষ বক্তা। কিন্তু কীভাবে অবলুপ্তির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল কর্নিশ? 

সেই গল্প বলার আগে আরও একটি মজার তথ্য দিয়ে রাখা যাক। কর্নিশ ভাষার অবলুপ্তির পর এই ভাষার ইতিহাস এবং ডলি পেন্ট্রেথের সম্পর্কে সর্বপ্রথম গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন ভাষাবিদ প্রিন্স লুই লুসিয়েন বোনাপার্ট। যিনি সম্পর্কে কিংবদন্তি ফরাসি শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ভাগ্নে।

যাই হোক, এখনও পর্যন্ত পাওয়া নথি অনুযায়ী, ষোড়শ শতকে কর্নিশ উপদ্বীপে বাস করতেন সবমিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক মানুষ। যাঁদের মাতৃভাষা ছিল কর্নিশ। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই ভাষার ওপর আগ্রাসন শুরু হয় ইংরাজির। কর্নিশের পরিবর্তে ইংরাজি ভাষা ব্যবহারের জন্য বাধ্য করা স্থানীয় গির্জাগুলিকে। ব্রিটিশ শাসকের এই সিদ্ধান্তে সে-সময় রক্তাক্ত বিদ্রোহের পথেও হেঁটেছিল কর্নওয়াল। 

অবশ্য তাতে লাভ হয়নি কোনো। এরপর থেকেই নাটকীয়ভাবে কমতে থাকে কর্নিশ ভাষার কথকের সংখ্যা। অষ্টদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মাউসহোলের মাত্র কয়েকটি পরিবারেই ব্যবহৃত হত এই ভাষা। ১৭৭৭ সালে শেষ বক্তা ডলি পেন্ট্রেথের মৃত্যুর পর যা অবলুপ্ত হয়ে যায় সম্পূর্ণভাবে। 

এই ঘটনার প্রায় একশো তিরিশ বছর পর, কর্নিশ নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করেন ব্রিটিশ অধ্যাপক ও কর্নিশ পণ্ডিত হেনরি জেনার। প্রাচীন নথি ঘেঁটে কর্নিশ ভাষার একটি হ্যান্ডবুকও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। মূলত এই হ্যান্ডবুকে নথিভুক্ত হয়েছিল কর্নিশ ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ ও তাদের অর্থ। জেনারের হাত ধরেই পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কর্নিশ ভাষা ঢুকে পড়ে অ্যাকাডেমিক প্রাঙ্গণে। শুরু হয় বিস্তারিত গবেষণা। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ‘অবলুপ্ত’ ভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল কর্নিশ। 

আশির দশকের শেষের দিকে জেনারকে সম্মান জানিয়ে মাউসহোলে তৈরি হয়েছিল কর্নিশ ভাষার একটি বিশেষ ক্লাব। বিগত কয়েকবছর ধরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন করে কর্নিশ ভাষার বীজবপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই ক্লাব। বর্তমানে অন্ততপক্ষে ১০ হাজার শিক্ষার্থী কর্নিশ ভাষাড় পাঠ নিচ্ছে কর্নওয়ালের ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাশাপাশি এই ভাষায় অনূদিত হয়েছে একাধিক বৈশ্বিক সাহিত্য। যার মধ্যে যেমন রয়েছে শেক্সপিয়ারের কালজয়ী গ্রন্থরা, তেমনই কিশোর পাঠকদের আকর্ষিত করতে কমিক বই ‘টিনটিন’-ও অনূদিত হয়েছে কর্নিশে। ফলাফল হিসাবে বর্তমানে মাউসহোলের বহু স্থানীয় মানুষই আজ সাবলীলভাবে কর্নিশ ভাষায় কথা বলতে সক্ষম। এমনকি ২০১০ সালে কর্নিশ ভাষার ওপর থেকে ‘অবলুপ্ত’ তকমা সরিয়ে, ‘বিপন্ন’ ট্যাগ দেয় ইউনেস্কো।

তবে শুধু যে স্থানীয়রাই এই ভাষার পাঠ নিচ্ছেন, এমনটা নয়। পরিসংখ্যান বলছে, লকডাউনের সময়ে যুক্তরাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তের মানুষ অনলাইনে পাঠ নিয়েছেন কর্নিশ ভাষার। এমনকি নাটকীয়ভাবে বিক্রি বেড়েছে ইংরাজি-কর্নিশ অভিধানের। সবমিলিয়ে এ-যেন ভাষার পুনর্জন্ম। 

Powered by Froala Editor