আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। ১৯৯১ সাল। তখন গালফ ওয়ারের সময়। কাতারে কাতারে মানুষ মারা যাচ্ছে ইরাক-কুয়েতে। আগুন জ্বলছে আরবে। সেইসময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ইরাক থেকে খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন একটি মাটির ট্যাবলেট। সেটি যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না সৈন্যদের মধ্যেও। কাজেই দেশে ফেরার সময় তা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। ট্যাবলেট দুটির (Clay Tablets) জায়গা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিউজিয়ামে।
তারপর পেরিয়ে গেছে ২৫ বছর। এই দুটি ট্যাবলেটের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন সকলে। ২০১৬ সালে একটি গবেষণার সূত্রেই হঠাৎ ট্যাবলেট দুটি নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুই মার্কিন গবেষক— ম্যানফ্রেড ক্রেবারনিক এবং অ্যান্ড্রু আর. জর্জের। নতুন করে তাঁরা অধ্যয়ন শুরু করেন এই ট্যাবলেটগুলি নিয়ে। ৫ বছর পর এবার তাঁদের সৌজন্যেই প্রকাশ্যে এল প্রাচীন এক অজানা ভাষার বর্ণমালা। সমাধান মিলল আদিম এক ভাষা-রহস্যের।
আমোরিট ভাষা (Amorite Language)। এই ভাষাটি ক্যানানি ভাষা পরিবারের সদস্য। আজ থেকে ৪০০০ বছরেরও আগে এই ভাষা অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলেই ধারণা গবেষকদের। অধুনা সিরিয়া, ইজরায়েল ও জর্ডন— এই তিন দেশ মিলেই তৎকালীন সময়ে গড়ে উঠেছিল কানান রাজ্য। আর সেখানেই মূলত বসবাস ছিল অ্যামোরিটদের। তারা ব্যবহার করতেন এই প্রাচীন ভাষার। পরবর্তীতে মেসোপটেমিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে আক্কেডিয়ান, আরামিক ও হিব্রু ভাষা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অবলুপ্ত হয় অ্যামোরিট। মজার বিষয় হল, এতদিন পর্যন্ত এই ভাষার সুনির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত কোনো নথিই হাতে পাননি গবেষকরা। ফলে, সেই ভাষার পাঠোদ্ধারও সম্ভব হয়নি এতদিন। কিন্তু কীভাবে সেই জটিল ধাঁধাঁর জট খুললেন গবেষকরা?
রোসেটা স্টোনের মতোই, ইরাক থেকে প্রাপ্ত ট্যাবলেটগুলি কোনো স্বতন্ত্র সাহিত্য বা নথি নয়। বরং, তা প্রাচীন অনুবাদের নজির। দুটি ট্যাবলেটের মধ্যেই হদিশ মিলেছিল দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষার। যার মধ্যে একটি ভাষা আক্কেডিয়ান। আক্কেডিয়ান ভাষার পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার হয়েছে বহু আগেই। ফলে তা চিহ্নিত করতে সমস্যা হয়নি খুব একটা। তবে দ্বিতীয় ভাষাটি চিহ্নিত করাই সমস্যার হয়ে উঠেছিল গবেষকদের কাছে। প্রাথমিকভাবে যার সমাধান না মিললেও, কিছু প্রাচীন নিদর্শন থেকে গবেষকরা চিহ্নিত করেন ভাষাটি আদতে অ্যামোরিট। যার সঙ্গে প্রভূত মিল রয়েছে আরামিক ও হিব্রুর। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, কোনো অ্যামোরিট পাণ্ডুলিপির সংরক্ষণ করতেই এ-ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মেসোপটেমিয়ার পণ্ডিতরা।
এই দুই ভাষার তুলনা করেই অ্যামোরিটের বর্ণমালা, বেশ কিছু শব্দ, সম্পূর্ণ বাক্য, বাক্যাংশ এবং ব্যাকরণের হদিশ পেয়েছেন ভাষাবিদ এবং গবেষকরা। তবে এই ট্যাবলেটগুলিতে লিপিবদ্ধ নথি কোনো প্রাচীন সাহিত্যের অংশ নয়। বরং, গবেষকদের মতে এই ট্যাবলেট ছিল প্রাচীন মানুষদের কাছে গাইডবুক মাত্র। আক্কেডিয়ান ভাষাভাষির মানুষদের আমোরিট ভাষার জ্ঞান এবং আমোরিটদের রীতি-রেওয়াজের কথা জানাতেই এই ট্যাবলেট লেখা হয়েছিল সে-সময়। কেন-না সেখানে তুলনা করা হয়েছে, মেসোপটেমিয়ান এবং আমোরিট দেবতার, তাছাড়াও লেখা হয়েছে শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ, বিদায়-এর মতো শব্দের অর্থ।
উল্লেখ্য, আমোরিট ভাষার সঙ্গে হিব্রু লিপির সাদৃশ্য রয়েছে বহু অংশে। তাছাড়া আমোরিট অবলুপ্ত যাওয়ার প্রায় ১০০০ বছর পর জন্ম নিয়েছিল হিব্রু লিপি। ফলে সম্ভাবনা থেকেই যায় অবলুপ্ত আমোরিটই হয়তো বিবর্তনের পথে হেঁটে জন্ম দিয়েছিল হিব্রুর। এই রহস্যের সমাধান খুঁজতেই আগামীতে গবেষণা চলবে বলেই জানাচ্ছেন জর্জ এবং ম্যানফ্রেড। হাতিয়ার ইরাক থেকে পাওয়া ট্যাবলেট দুটিই…
Powered by Froala Editor