শব্দ ও গন্ধের প্রদর্শনীতে শহরজীবনের স্মৃতির পরীক্ষা কলকাতায়

বর্ষার সপ্তাহান্তে উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন। রাস্তায় হাঁটুজলে পা ডুবিয়ে হেঁটে চলেছেন মানুষ। অথচ এসবের মধ্যেই শ্যামবাজার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের নিকটে রমাকান্ত বোস স্ট্রিটের উপর ‘কমলা প্যালেস’-এ ভিড় করতে শুরু করেছেন শহরের মানুষ। গত ৩০ ও ৩১ জুলাই, অর্থাৎ শনি ও রবিবার এক অভিনব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে। শহরের শব্দ এবং গন্ধ, অর্থাৎ যে অনুভূতিগুলি ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা গেলেও ছুঁয়ে দেখা যায় না, তাদের নিয়েই এই প্রদর্শনী (Exhibition)। আয়োজনের নাম ‘শহরের সংবেদন’ (Shohorer Songbedan)। প্রদর্শনী বলতেই যাঁদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছবি বা মূর্তির সংগ্রহ, তাঁদের কাছে এটা অন্য স্বাদের তো বটেই। পুরনো বাড়িটার চাতালে পা রাখতেই চোখে পড়ল মাঝের গোল ঝর্ণাটিকে ঘিরে কয়েকটি বাঁশের তৈরি কুঠুরি। প্রতিটি কুঠুরির মধ্যে রয়েছে একটি করে আতরদানি। আর চাতালকে ঘিরে ঝুলছিল প্রায় ২০টি হেডফোন।

আতরদানিগুলি নাকের কাছে আনলেই একটি করে বিশেষ গন্ধ এসে লাগে। প্রতিটি হেডফোন কানে লাগালে শোনা যায় তিনটি করে পৃথক শব্দ। কিছু গন্ধ, কিছু শব্দ খুবই পরিচিত। শহর কলকাতার (Kolkata) সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে সেইসব অনুভূতি। আবার কিছু শব্দ বা গন্ধ চিনতে একটু সমস্যা হয় বৈকি! কারণ একসময় তারা শহরের অবিচ্ছেদ্য পরিচিতি হয়ে থাকলেও আজ ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে।

“আসলে সেন্সরি হেরিটেজ নিয়ে অ্যাকাডেমিক স্তরে যত কাজ হয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিষয়টির পরিচয় ঘটানোর কাজটা সেভাবে হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম কলকাতা শহরের মানুষ এইসমস্ত ঐতিহ্যকে চিনুক এবং মনে রাখুক। এখানে ঐতিহ্য বলতেই তো মূলত স্থাপত্য সংরক্ষণের কথা ভাবা হয়। এর বাইরেও শহরের ঐতিহ্যের একটা বড়ো অংশ রয়েছে, যাকে মূলত স্মৃতিতেই ধরে রেখেছেন মানুষ। আমরা এটাও জানতে চেয়েছিলাম, মানুষ কতটা এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত? অথবা এই শব্দগুলিকে কতটা চেনেন?” বলছিলেন ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডক্টর ঋষিকা মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
শব্দে-গন্ধে ঐতিহ্যের খোঁজ, অভিনব প্রদর্শনীর আয়োজন কলকাতায়

প্রদর্শনীর আয়োজনেও ধরা পড়ে যায় সেই উদ্দেশ্য। প্রদর্শনী দেখতে আসা মানুষদের কাছেও তাই এ যেন এক পরীক্ষা। প্রতিটা হেডফোন এবং আতরদানির পাশে রাখা রয়েছে কিছু কার্ড। আর সেই কার্ডে দর্শকরা লিখতে পারবেন, গন্ধ বা শব্দটি সম্বন্ধে তাঁদের কী মনে হল। শহর কলকাতার মানুষের স্মৃতি যে খুব কমজোরি নয়, সেটা কার্ডে লেখা উত্তরগুলি পড়ে বোঝাই যাচ্ছিল। তবে অনেকেই ভুলও করেছেন। চবন বাহার এবং পান মশলার গন্ধের মধ্যে চিনতে ভুল করেছেন কেউ। কেউ আবার শিল কাটার শব্দ এবং পাথরে অক্ষর খোদাইয়ের শব্দ চিনতে ভুল করেছেন। তবে দর্শকরা তাঁদের মতো করে শব্দ ও গন্ধগুলি চেনার চেষ্টা করছেন, এবং সেই চেষ্টায় তাঁরা কতদূর সফল হচ্ছেন তাও ভাগ করে নিচ্ছেন আয়োজকদের সঙ্গে। তাই আয়োজকরাও রীতিমতো খুশি। শহরের মানুষের এই সমস্ত উত্তরগুলি নিয়েই আগামীদিনে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করতে চলেছেন ঋষিকা এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের অধ্যাপক রক্তিম রায়। ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল হেরিটেজ স্টাডি এবং ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণার অংশ হিসাবেই কলকাতা শহরের বুকে দু-দিনের এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
ক্যানসারাক্রান্ত ম্যাজিশিয়ান, চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিশেষ ম্যাজিক প্রদর্শনী সতীর্থদের

দু-দিনের এই প্রদর্শনীর জন্য অবশ্য প্রস্তুতি চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে। এগিয়ে এসেছেন দমদম মতিঝিল কলেজের অধ্যাপক সায়ন্তন দাস, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নীলাঞ্জন দাস এবং ইন্দাস ভ্যালি ওয়ার্ল্ড স্কুলের সুরমিতা কাঞ্জিলালের মতো তরুণ-তরুণীরা। মূলত চিৎপুর রোডকে ঘিরেই চলেছিল নমুনা সংগ্রহের কাজ। এছাড়াও শহরের অন্য বেশ কিছু অঞ্চল থেকেও সংগ্রহ করা হয়েছিল শব্দ এবং গন্ধ। বৃষ্টি পড়ার শব্দের মতো প্রাকৃতিক শব্দও যেমন আছে, তেমনই আবার আছে ট্রাম বা স্টিমারের যান্ত্রিক শব্দও। একটি হেডফোন কানে নিতেই হঠাৎ শুনতে পাওয়া যায় রাজনৈতিক মিছিলের উদ্ধত স্বর। আবার সেই স্বর মিলিয়ে যেতেই ভেসে আসে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে উৎসবমুখর শোভাযাত্রার ধ্বনি। ঢাক-ঢোলের শব্দ থামতেই বেজে ওঠে চিৎপুরের বিখ্যাত ব্যান্ড-পার্টির শব্দ। তিনটি ভিন্ন স্বাদের মিছিলের শব্দ যেন একসঙ্গে অর্কেস্ট্রা তুলেছে একটিমাত্র হেডফোনে। আবার কোথাও মহিলা ফেরিওয়ালার ডাক, কোথাও ফল বিক্রেতা একটি জায়গায় বসে ডাকছেন ক্রেতাদের। কোনো কোনো ফেরিওয়ালা আবার নিজের মুখে নয়, বরং মাইকে রেকর্ড করা শব্দ শুনিয়ে ফেরি করেন। সেই শব্দও আলাদা করে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন
মানুষই সর্বোত্তম? প্রশ্ন তুলছে ‘ভেনিস বায়েনালে’ প্রদর্শনী


চাতালের মাঝে রাখা ঠিক ৮টি আতরদানি। কোনোটির মধ্যে হিং-এর গন্ধ, কোনোটিতে রয়েছে ধুনোর গন্ধ। আবার মাছের বাজারের গন্ধও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে একটি আতরদানিতে। সেই গন্ধ হয়তো তেমন সুন্দর নয়, তবু শহরের মানুষের জীবনের সঙ্গে যে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে। সায়ন্তন বলছিলেন, “শব্দগুলিকে সংরক্ষণের পাশাপাশি ম্যাপিং-এর ব্যবস্থাও করেছি আমরা। যাতে ভবিষ্যতে আর্কাইভ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শব্দটি কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের। গন্ধের ক্ষেত্রে তো সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কোন অঞ্চল থেকে গন্ধগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে সেই তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।”

এভাবেই প্রত্যেকের চেষ্টায় শব্দ ও গন্ধ সংগ্রহ করার পর বাকি ছিল শুধু প্রদর্শনীটি সাজিয়ে তোলা। এই কাজটিতেও আন্তরিকতার কমতি রাখেননি তাঁরা। ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো সাহিত্যিকের রচনা থেকে শহর কলকাতার শব্দ ও গন্ধের নানা বর্ণনা খুঁজেছেন সুরমিতা। সেই বর্ণনাগুলি ফ্লেক্সে ছাপিয়ে রাখা ছিল চাতালজুড়ে। আবার পুরনো বাড়ির চাতালের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা ফোয়ারাটিকেও কাজে লাগিয়ে নিয়েছেন নীলাঞ্জন। তার চারদিকে বাঁশের চৌকো বেড়া তৈরি করে চারদিকে সাজিয়েছেন মোট ৮টি কুঠুরি। আর প্রতিটা কুঠুরিতে রাখা আতরদানিগুলিও বেছেছেন ফোয়ারার আকারের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে। নীলাঞ্জন বলছিলেন, “কেন্দ্রে গোলাকার কোনো কাঠামোকে ঘিরে চৌকো নকশা, এটা ইসলামিক স্থাপত্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। তবে কলকাতা শহরের পুরনো বাড়িগুলি দেখলেও এই বিষয়টি ভীষণভাবে দেখা যায়।”

প্রায় ৩০০ বছর আগে উত্তর কলকাতার এই চিৎপুর অঞ্চল থেকেই শুরু হয়েছিল আধুনিক শহর কলকাতার পথচলা। গঙ্গা নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক নতুন বাস্তুতন্ত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের পরিসর বেড়েছে। এগিয়েছে সভ্যতার রথও। আধুনিক শহুরে জীবনে প্রয়োজন ফুরিয়েছে শিল কাটার কারিগরদের অথবা পাথরের গায়ে অক্ষর লেখার শিল্পীদের। তেমনই হারিয়ে যেতে বসেছে রকমারি পান মশলা থেকে শুরু করে ধুনো-গুগ্গুলের গন্ধও। কেবল ঐতিহ্যের শিকড় আঁকড়েই তারা এখনও কোনোরকমে টিকে আছে। হয়তো একদিন চিরতরেই হারিয়ে যাবে। মানুষের জীবনকে তো জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। তবে সেই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শব্দ ও গন্ধ সংরক্ষণের এই অভিনব উদ্যোগ আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে নিশ্চই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More