প্রতিটি নদীরই অজস্র গল্প থাকে। কিছু গল্প থেকে যায়, বেশিটাই থাকে না। নদীগর্ভে হারায়। হুগলি নদীর (Hooghly River) এমন অনেক গল্পই নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়েছে। সেগুলি অতল থেকে খুঁজে আনা প্রায়-অসম্ভব। তবু, যেগুলো ছড়িয়ে আছে আনাচেকানাচে— সেগুলোও তো ধরে রাখা দরকার। মেটকাফ হলে দেখা গেল তারই নিপুণ প্রচেষ্টা।
মেটকাফ হলে 'হুগলি হেরিটেজ হাব' (Hooghly Heritage Hub)- ম্যাক্সমুলার ভবন ও ইউনিক (ইউরোপিয়ান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কালচার) গ্লোবালের উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি প্রকল্প। তারই একটি প্রদর্শনী চলছে মেটকাফ হলে। ভারতের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক, ইন্দো-ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির আদানপ্রদান, ইন্দো-ইউরোপীয় অস্তিত্ব— পুরোটাকেই ধারণ করতে চেয়েছে এই প্রকল্প।
ভারতের সঙ্গে ইউরোপের মেলবন্ধনের ইতিহাসে হুগলি নদী ও বাংলার ভূমিকা নেহাত কম নয়। ইংরেজদের আধিপত্য কায়েমের আগে থেকেই বাংলার সঙ্গে বিশ্বের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মার্কোপোলো থেকে ইবন বতুতার লেখাতেও বাংলার মসলিনের বিশ্বব্যাপী চাহিদার কথা জানা যায়।
আরও পড়ুন
শিল্পীদের তুলিতে পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রদর্শনী মার্কিন রেস্তোরাঁয়
তারপর আরো বেশকিছু শতাব্দী পেরিয়ে বাংলার ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হওয়া— এইসব পটপরিবর্তন, সংঘাতের চিহ্ন আজও বহন করছে হুগলি নদী।
আরও পড়ুন
শিল্পী হরেন দাসের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দক্ষিণ কলকাতায়
নদীর তটরেখা বদলেছে যেমন যেমন, ইতিহাসও তার বাঁক বদলেছে পাল্লা দিয়ে। নদীর তীরে তীরে ব্রিটিশ আধিপত্য শুধু নয়। নদী বাংলার কূলে এনে দিয়েছে ফরাসি, স্কটিশ, দিনেমার, ডাচ ও আরো অনেককেই। রেলপথ হয়েছে। ইস্কুল-কলেজ হয়েছে। পুরোনো বসতি ভেঙে নতুন বসতি গড়েছে। এভাবেই বদলেছে ইতিহাস, ভূগোল বদলেছে। মানুষের জীবন, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আমূল বদল ঘটেছে মাত্র এক শতকে। হুগলি নদী এই সমস্ত কথা জানে। নদীকে নতুনভাবে চেনা আসলে তো নিজেদের অস্তিস্ত্বকেই নতুন করে খুঁজে নেওয়া। সেটারই সুযোগ মিলবে ১২নম্বর স্ট্র্যানন্ড রোডে অর্থাৎ মেটকাফ হলে। হুগলি নদীর গল্পকে নিয়ে এই প্রদর্শনীর গল্পকার বা গবেষক সাংবাদিক নাজেস আফরোজ। নদীর প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি ঘাটে কীভাবে এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মানচিত্র বদলে বদলে গেছে- ছবিতে-গল্পে তার নিবিড় বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন
সমপ্রেমের ছবিতে একাকার যিশু-কৃষ্ণ, কলকাতার বুকে একটুকরো প্রদর্শনী
প্রদর্শনীটিকে অপূর্বদর্শন করে তুলেছেন সুকন্যা ঘোষ।
একদা ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল মেটকাফ হলে। হুগলি নদীকে পশ্চিমে রেখে তৈরি-হয়ে-ওঠা এই হলের অন্যতম প্রাপ্তি ছিল নদীর হাওয়া। যতই স্ট্র্যা ন্ডরোডের সাঁসাঁ গাড়ি থাকুক, যতই মাঝখানে রেলপথ থাকুক, মেটকাফ হলের অলিন্দে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকালে দুই শতক পিছিয়ে যাওয়া যায়। সেখানে এই অনবদ্য প্রদর্শনী, নদীর এইসব রূপকথার গল্পের মতো ইতিহাসকে এখানে দেখতে পাওয়া উপরি পাওনা বটে।
২৬শে নভেম্বর শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী। চলবে এ-বছরের শেষদিন পর্যন্ত। ফলে, সুযোগ পেলে শীতের এই মরশুমে একবার ঢুঁ মারাই যায়!
ছবি – সুরমিতা কাঞ্জিলাল
Powered by Froala Editor