প্রয়াত কবি গৌতম বসু, শোকস্তব্ধ পাঠকমহল

“কিছু ভয় বৃষ্টির রাতের জন্য সঞ্চিত থাকত
ঝড়ের যন্ত্র যখন অবিরাম প্রসবিনী, কিছু ভয় অনাথ;
শব্দও একপ্রকার অন্ধকার, যার উদ্দেশে কান পাতা রয়েছে
যার ভিতর, তমসা তাদের পথের কাঁটা, অহর্নিশ
জল বিতরণ করে, বৃক্ষের কুহক; আর এমন
নিদ্রার শোভা কেউ দেখেছে, কেউ দেখে নি
শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে, প্রথম রহস্য
অথবা সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা।”

কোথাও কোনো বাড়তি উচ্চারণ নেই। নেই কবিতার মধ্যে দিয়ে ছবি তৈরির কোনো প্রয়াস। শুধুই গভীর অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখছেন একটা মুহূর্তকে। আবার সেই দৃষ্টি যেন বহু দূর থেকে দেখছে। বাংলা কবিতার জগতে এমন সংযত সৃষ্টি খুবই কম। কবি গৌতম বসু তাই নিঃসন্দেহে একজন ব্যতিক্রম ছিলেন।

১৯৫৫ সালের ১৩ মে দার্জিলিং-এ জন্ম গৌতম বসুর। তারপর বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। ৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে সহপাঠীদের উদ্যোগেই তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘শতভিষা’ পত্রিকায়। আর তরুণ বয়সেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দশজনের একজন হয়ে থাকতে আসেননি। তিনি একজন ব্যতিক্রম। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হল গৌতম বসুর প্রথম কবিতার বই। ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’। স্বল্প দৈর্ঘের, শিরোনামহীন মাত্র ২২টি কবিতার সংকলন। এর কয়েকটি আগের এক দশকে বেশ কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন গৌতম বসু। ষাটের দশকের কবিতা যেভাবে সোচ্চারে হাজির হয়েছিল, সেখান থেকে যেন আবার এক আত্মমগ্নতার জগতে ফিরতে চাইছেন কবি। এটাই ছিল তাঁর লেখার মূল শক্তি। পাঠকরা অপেক্ষা করে থাকলেন তাঁর পরবর্তী বইয়ের জন্য। তবে সেই বই প্রকাশিত হল আরও এক দশক পরে। ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’ প্রকাশিত হল ১৯৯১ সালে।

কর্মসূত্রে কবিকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে নানা জায়গায়। ব্যাঙ্কের কর্মচারী ছিলেন। সেইসূত্রে গ্রামেগঞ্জে মানুষের জীবনকে দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে। আর তার মধ্যেই চলেছে নিবির সাহিত্যপাঠ। এই ব্যস্ততা হয়তো কম কবিতা লেখার একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছিলেন, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কবিতার বাছাই অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি মনে করতেন স্বল্প দৈর্ঘের বইয়ের একটা আলাদা শক্তি আছে। আর তা অনেক বেশি কঠিনও। কারণ কয়েকটামাত্র কবিতার মধ্যে একটি কবিতা দুর্বল হলেও গোটা বইটা দুর্বল হয়ে পড়ে।

গৌতম বসুর প্রথম তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে ঠিক ১০ বছরের ব্যবধানে। ২০০১ সালে ‘রসাতল’ প্রকাশিত হওয়ার পর অবশ্য ২০০৭-এ ‘নয়নপথগামী’ এবং ২০১১ সালে ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’ প্রকাশিত হয়েছে। এরপর ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ‘মঞ্জুশ্রী’ ও ‘জরাবর্গ’। এই শেষ সময়ে এসে তিনি নাকি একটু বেশিই কবিতা লিখে ফেলেছিলেন, এই ছিল তাঁর আক্ষেপ। চিরকাল সংযমের মধ্যে বেঁধে রেখেছেন নিজেকে। জীবৎকালেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধের সংকলন। অথচ তাতে অগ্রন্থিত লেখার সংখ্যা খুবই কম। তিনি বলতেন, যে লেখা শক্তিশালী হবে না তাকে চিরকালের জন্য ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। এই ফেলে দেওয়া, ভুলে যাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।

আজ সকালে সাহিত্যের জগৎ থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন গৌতম বসু। শুধু রেখে গেলেন মাত্র ৭টি কাব্যগ্রন্থ আর অসংখ্য প্রবন্ধ। একে একে নিভিছে দেউটি। এভাবেই একটু একটু করে নিঃস্ব হয়ে পড়ছি আমরা। এই শূন্যস্থান পূরণ হবে না কোনোদিন।

Powered by Froala Editor