চৈত্র দিনের বেলা ক্রমেই যেন কমে আসছে। রোদের উত্তাপ বাড়ছে ধীরেধীরে। নদী, নালা, পুকুর সব শুকিয়ে যেতে বসেছে। মানুষ বিকালের রোদ পড়ে এলে বের হচ্ছে ভ্রমণে। এই সব চিত্রগুলিই হল চৈত্রের আসল ছবি। এর মধ্যেই হঠাৎ যেন প্রবেশ করে বৈশাখ মাসের বেলা। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে বয়স্ক পুরুতঠাকুর সুর করে পঞ্জিকা পড়তেন আর তার আশেপাশে সবাই শুনতেন মন দিয়ে। তাদের আগ্রহ থাকত কবে রথযাত্রা হবে? কবে হবে মহালয়া বা দুর্গাপূজার দিনক্ষণ? সকলেই আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকত পুরুতঠাকুরের দিকে।
পুরুতঠাকুররাও সে-যুগে প্রচার করতেন শ্রোতাদের কাছে যে নতুন পঞ্জিকার পাঠ যারা শোনে, সব তীর্থে দর্শনের ফল তারা একসঙ্গে পায়। এমনকি তারা পঞ্জিকা-মাহাত্ম্য শোনাতে গিয়ে বলতেন - ‘বর্ষারম্ভে স্বয়ং মহাদেব কৈলাসে বসে পার্বতীকে নতুন পঞ্জিকা পাঠ করে শোনাতেন!’ দেবজ্ঞ পুরুত উপদেশ দিতেন সবাইকে পঞ্জিকা বিধি মেনে চলার জন্য। যেমন, চৈত্র সংক্রান্তির পর নিমপাতা খাওয়া বারণ, শ্রাবণ ষষ্ঠীর দিন চোদ্দ শাক খেতে হয়, সপ্তাহে কবে দাড়ি কাটতে হয় বা কবে মেয়েদের কালিমাটি দিয়ে মাথা ধুতে হয়। এছাড়াও স্বপ্নফল, টিকটিকির হাঁচি সব ব্যাখ্যাই আছে। একমাত্র মৃত্যুর সময় পঞ্জিকার ফলফল কাজ করে না তাই অখণ্ড বাংলাদেশে মানুষের মুখে ঘুরত, ‘যমের বাড়িতে নেই পাঁজিপুথিঁ’।
এখনকার মতো আগেও পঞ্জিকা ছিল দুই প্রকার, পূর্ণাঙ্গ পঞ্জিকা এবং হাত পঞ্জিকা বা পকেট পঞ্জিকা। তবে আকৃতিতে যাই হোক, পঞ্জিকার বিধি ও ফলাফল কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই একই ছিল। তাতে ছুটির দিন, যাত্রার শুভক্ষণ, বিদেশ ভ্রমণ, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি, ঝড়বৃষ্টি বা বন্যা সম্পর্কে থাকত স্পষ্ট আভাস। পঞ্জিকাগুলির বাইরে ও ভেতরের পাতায় কাঠের বা ধাতুর ব্লকে ছাপা থাকত পাঞ্জাবের জলন্ধরের সর্বরোগের মহৌষধ বা প্রেত তাড়াবার জন্য তান্ত্রিকের মহাআয়নার ছবি। বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত বড়ো হরফে ‘বিফলে মূল্য ফেরৎ’!
নববর্ষের পর শহরের দোকানে, বাজারে, ধনীদের বাড়িতে ছাড়াও গ্রামের হাটে, মেলাতে বিক্রি হত হুড়হুড় করে। এমনকি পঞ্জিকা বোঝাই করে ঝাঁকা মাথায় ফেরিওয়ালা গ্রামে-গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করতে বের হত। হিন্দু বাড়িতে পঞ্জিকা কেনার পরও হত বিশেষ অনুষ্ঠান, সেখানে পুরোহিতকে ডেকে জেনে নেওয়া হত পূজা-পার্বণের দিন, মলমাস, বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা উপনয়নের শুভ দিনগুলি। তার জন্য পুরোহিতকে কিছু নগদ দক্ষিণা বা ভূজ্জি দেওয়া হত। যদিও ব্যক্তিগত রাশিফল নিয়ে সেযুগের মানুষের আগ্রহ একবারে ছিল না বললেই চলে, তাই প্রথম দিকের পঞ্জিকাগুলোতে বহুদিন রাশিফল বা লগ্নফল দেওয়া থাকত না।
বাংলা ভাষায় প্রথম পঞ্জিকা ছাপা হয়েছিল ১৮১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে বা বাংলার ১২২৫ সনে। অবশ্য তার আগে হাতে লেখা পঞ্জিকার চল ছিল সমগ্র বাংলাতে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, নবদ্বীপ বা ভাটপাড়ার হাতে লেখা পঞ্জিকার বেশ সুনাম ছিল। তেমনই পূর্ববঙ্গে বাকলা, খানাকু্ল, গণপুরের পঞ্জিকার নামডাক ছিল। এইসব হাতে লেখা পঞ্জিকাগুলোকে তখন মানুষ পাজিঁপুথিঁ নামে ডাকত। তবে হাতে লেখা পঞ্জিকাকে বাদ দিয়ে সহজে মানুষ ছাপা পঞ্জিকাকে গ্রহণ করেনি। কারণ ছাপা পঞ্জিকাকে তারা প্রথম দিকে ধর্মাচারণের পরিপন্থী হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল। পরে প্রকাশকরা বিখ্যাত পঞ্জিকার গণৎকারদের নাম ও অনুমতিসহ ছাপা হলে মানুষ গ্রহণ করতে শুরু করে।
পরবর্তীকালে, পঞ্জিকাকে আরও বিখ্যাত করতে পঞ্জিকার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ডাইরেক্টরিকে, তাতে ভারতের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের নাম, ঠিকানা, অফিসার-বিচারকদের নাম ও বেতনেরও উল্লেখ থাকত। এ-ব্যাপারে পথিকৃৎ পি এম বাগচির পঞ্জিকা ও ডাইরেক্টরি। তবে মানুষের পঞ্জিকার প্রতি ঝোঁক দেখে ১৮৪০-এর দশকে সর্বপ্রথম যৌথ উদ্যোগে এগিয়ে আসে কোলকাতা ট্রাফট সোসাইটি এবং চার্চ অফ ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাদের পঞ্জিকার বিক্রি খারাপ হওয়ায় কয়েক বছরের পরই ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। তারপরই ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে উত্থান হয় ভার্নাকুলার লিটারেচার কমিটির। তারাই প্রথম সুমুদ্রিত এবং তথ্যসমৃদ্ধ পঞ্জিকার প্রকাশ করে। এখানেই প্রথম অখণ্ড বাংলার ৩০৯টি মেলার সঠিক বিবরণ দেওয়া ছিল, যদিও এই পঞ্জিকাও মানুষের খুব বেশি সমাদর পায়নি।
ভার্নাকুলার লিটারেচার কমিটির এই পঞ্জিকা সম্পর্কে পাদ্রি লং সাহেব লিখেছিলেন- “১৮৫৭ সালে কেবল কলকাতা বাজারেই এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার পঞ্জিকা বিক্রি হয়েছিল।” যদিও পরে জানা সেই সংখ্যা ছিল আড়াই লক্ষেরও বেশি। এই লাভজনক দিককে দেখে ব্রিটিশ কোম্পানি স্যান্ডার্স অ্যান্ড কোনস বিলেতের ছবি দিয়ে সাজিয়ে ছাপতে শুরু করেছিল, যার পাতা সংখ্যা ছিল ৩০৪ এবং দাম ছিল সাত আনা। এই সময়ে অর্থাৎ ১৮৬০-৭০ দশককে বাংলার পঞ্জিকার স্বর্ণযুগ বলা হয়। এইসময় বাংলা পঞ্জিকাগুলোর দাম ছিল এক টাকা। কিন্তু কয়েক দশকেই প্রকাশকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এতটাই বেড়ে যায় যে, পঞ্জিকাগুলোর দাম মাত্র দু-তিন আনাতে নেমে আসে। ভেতরের পাতাতে প্রথম রেলযাত্রার ছবিশোভিত পাতা বা ময়দানে বেলুন ওড়ানো ছবি থাকলে তাতে বিক্রি হুহু করে বাড়ত।
ছবি ও মুদ্রণশিল্পের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল হুগলির শ্রীরামপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের চন্দ্রোদয় প্রেস, যে প্রেসের দৌলতে বাংলা পঞ্জিকার প্রকাশকরা অর্থের বিপুল মুখ দেখেছিলেন। সময়ের সঙ্গে একদিন পঞ্জিকাও দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল, একদিকে লোকনাথ ডাইরেক্টরি বা এম বাগচির ফুল পঞ্জিকা এবং অন্যদিকে মহম্মদী পঞ্জিকা।
এভাবেই ধীরে ধীরে বাঙালির হৃদয় ও মস্তিকে বাসা বেঁধেছিল পুঁজি আর পাঁজির খেলা। সে খেলা খেলতে খেলতে আজও বাঙালি দিশেহারা হয়। পুঁজিকে পাশে রেখে নতুন পাঞ্জাবি গলিয়ে কলেজ স্ট্রিট বা স্থানীয় বইয়ে দোকানে খোঁজ করে নতুন, লাল মলাটের ফুল পঞ্জিকাটিকে। এটা না হলে নববর্ষ জমে নাকি!
তথ্যসূত্র -
১. পূজা-পার্বণ - যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি
২. আবহমান বাংলা পঞ্জিকার বিবর্তন - গাজি আলমগির
৩. শুভ নববর্ষ ও আমাদের সংস্কৃতি - আয়ুব হোসেন
৪. নববর্ষ ও বাংলা লোকসংস্কৃতি - সূচিপত্র প্রকাশন
৫. বাংলার সামাজিক ইতিহাস সূত্র - হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
Powered by Froala Editor