সাজানো ডাইনিং টেবিলে বিভিন্ন পাত্রে রাখা আছে রকমারি খাবার। পাশেই রাখা ওয়াইনের বোতল। গ্লাস, প্লেট সবই আছে সাজানো। আর সারা বাড়ি, লনজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লোকজন। গল্প-গুজব করছে নিজেদের মধ্যে। চলছে একেবারে স্বাভাবিক আড্ডা। মাঝে মধ্যে এক বৃদ্ধ এসে কথা বলে যাচ্ছেন তাঁদের সঙ্গে। ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন বাড়ি, বইয়ের সংগ্রহ। গমগমে পরিবেশ একেবারে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের কারোরই ইতিপূর্বে আলাপ নেই একে অপরের সঙ্গে। এবং সকলেই প্রায় ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক।
শুনে আশ্চর্য লাগছে নিশ্চয়ই? নাকি মনে হচ্ছে পশ্চিমের কোনো রেস্তোরাঁর ছবিই বর্ণনা করা হচ্ছে এখানে? যা ভাবছেন তেমনটা একেবারেই নয়। প্যারিস শহরের এই বাড়ি আসলে ওই বৃদ্ধের ব্যক্তিগত নিবাস। আর বাকিরা সকলেই তাঁর অতিথি। সকলেই এসেছেন দূর-দূরান্তের কোনো দেশ থেকে। এবং আশ্চর্যের বিষয় তাঁদের সঙ্গে এর আগে আলাপ হয়নি স্বয়ং ওই বৃদ্ধেরও।
জিম হায়নেস। বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরেই তিনি চালিয়ে আসছেন এই কর্মযজ্ঞ। হ্যাঁ, কর্মযজ্ঞই বটে। সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকেই নিজের অতিথি করে তোলার এক কর্মসূচি নিয়েছিলেন জিম। নাম দিয়েছিলেন ‘ওপেন হাউস সানডে ডিনার’। আর এই অতিথি হওয়ার জন্য জিমের ওয়েবসাইটে কিংবা ই-মেলে নথিভুক্ত করতে হত নিজের নাম, ঠিকানা। করণীয় বলতে এটুকুই। একশো কুড়ি জনের বেশি হয়ে গেলে অবশ্য পরের সপ্তাহের জন্য অপেক্ষা করতে অনুরোধ করতেন জিম।
হ্যাঁ ‘করতেন’ই। কারণ চলতি মাসেরই ৬ তারিখে প্রয়াত হন জিম। বন্ধ হয়ে যায় কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা এই কিংবদন্তি অতিথিশালা। ১৯৮০ সাল নাগাদ এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন জিম। তারপর থেকে একদিনের জন্যেও বন্ধ হয়নি প্রতি রোববার এই উদ্যোগের। এমনকি লকডাউন শুরুর ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্তও খোলা ছিল তাঁর বাড়ি। কিন্তু বিস্ময় জাগছে নিশ্চয়ই, হঠাৎ এমন উদ্যোগ কেন কোনো ব্যক্তির?
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে একত্রিত করাই ছিল জিমের লক্ষ্য। বিভিন্ন সংস্কৃতির সম্পর্কে জানা এবং তাঁদেরকে পাশ্চাত্যের রীতিনীতি জানানো— এই উদ্দেশ্য নিয়েই অতিথিশালা খুলেছিলেন জিম। নিজের বাড়িতেই। দরজা খুলে দিয়েছিলেন সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই। নিজেও একজন প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন জিম। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব টান। তবে সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো কি আর সম্ভব? তাই নিজের বাড়িকেই মিলনক্ষেত্র করে তুলেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরে আসা যায়, বুঝিয়েছিলেন এই দশ ব্যক্তি
শেষ কয়েক দশক প্যারিসে থিতু হলেও জিমের জন্ম লুইসিয়ায়। মার্কিন বিমানবাহিনীতে কাজ করার সময় তাঁকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল স্কটল্যান্ডের স্কোয়াডে। তবে স্কটল্যান্ডের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন জিম। ছেড়ে দেন চাকরিও। তারপর এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করেন নতুন করে পড়াশোনা। বয়স তখন নেহাত কম নয়। পাশাপাশি জর্জ স্কোয়ারে শুরু করেন একটি বইয়ের দোকান। সেখানে পাওয়া যেত শুধুমাত্র পেপারব্যাক বই। তৎকালীন ব্রিটেনে আর কোথাও ছিল এমন দোকান।
১৯৬৩ সালে জন ক্যালডারের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি আয়োজন করেন নাট্য উৎসবের। পরবর্তীকালে লনমার্কেটের কাছে তৈরি করেন ট্র্যাভার্স থিয়েটার ক্লাব। নিজে একজন সক্রিয় নাট্যকর্মী ছিলেন জিম। তবে শুধু নাটক, থিয়েটারের মধ্যেই আটকে ছিল না তাঁর শিল্প-আগ্রহ। চেয়েছিলেন সমস্ত শিল্পীদের নিয়েই গড়ে উঠুক এক উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। ১৯৬৭ সালে তিনি তৈরি করলেন ডিউরি লেন আর্ট ল্যাব। সেই সংগঠনের অংশ ছিলেন ডেভিড বাউয়ি, জন লেনন, ইয়োকো ওনো’র মতো পরিচিত মুখেরা। সেই সময় তরুণ প্রতিভাবান লেখক, গায়ক, পরিচালকদের তুলে এনেছিলেন তিনি।
তবে কথায় আছে, শিল্পী মাত্রেই পাগল। জিমও তেমনই। বেশিদিন থিতু হতে পারলেন না ব্রিটেনে। ১৯৬৯-এ পাড়ি দিলেন ফ্রান্স। শুরু হল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের কাজ। পরবর্তী ৩০ বছর সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন জিম। বিষয় মিডিয়া এবং যৌন রাজনীতি। সেসময় তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন দেহকর্মীদের যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও। তবে এই নতুন জীবনের মধ্যে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছিল বিশ্বভ্রমণ, সংস্কৃতি-অন্বেষণ। বছর দশেক পরে তাই নিজেই বাড়িতে অতিথিশালা খুলে ফেলেছিলেন জিম।
আরও পড়ুন
নেট-দুনিয়ায় কি আদৌ সুরক্ষিত ব্যক্তিগত পরিসর? প্রশ্ন উস্কে দিচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ-বিতর্ক
প্রতি রবিবার সর্বোচ্চ ১২০ জন ব্যক্তি আমন্ত্রিত হতেন তাঁর বাড়িতে। ‘পার্টি’ চলত রাত ১১টা পর্যন্ত। তারপর বন্ধ সবকিছু। এ ব্যাপারে প্রচণ্ডরকম কড়া ছিলেন তিনি। কারণ, প্রতিবেশীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে যে। তবে কেউ চাইলে দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারতেন তাঁর বাড়িতে। সর্বোচ্চ ছ’মাস তাঁর বাড়িতে অতিথি হিসাবে কাটিয়ে গেছেন কোনো ব্যক্তি, রয়েছে এমন উদাহরণও। আজ পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন জিমের। তবে একেবারে বিনামূল্যে মিলত না এই পরিষেবা। বাড়ির প্রবেশপথেই রাখা থাকত একটি অনুদান বাক্স। তাতে খামে করে সামান্য কিছু দিলেই খুশি হতেন জিম। কেউ এক ডলার দিতেন আবার কেউ হাত খুলেই সাহায্য করে যেতেন জিমকে। নিজের খরচটুকু চালিয়ে বাকি পুরোটাই অসহায় মানুষদের হাতে তুলে দিতেন সাহায্য হিসাবে।
জিমের বাড়ির অতিথিশালা যখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পায়, তখন হতবাক হয়ে গিয়েছিল প্যারিসের পুলিশও। এমনকি বেশ কয়েকবার অনুসন্ধানেও হানা দেয় তাঁরা। বিশ শতকের শেষের দিক থেকেই জিমের এই সানডে ডিনার হয়ে উঠেছিল প্যারিস ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রচারেই বিশ্বাসী ছিলেন না জিম। তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর কথা। তাঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কিছু সাংবাদিকও। তাঁরাও বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেন জিমের এই উদ্যোগকে।
‘অতিথি দেব ভবঃ’ কিংবা ‘অতিথি নারায়ণ’— এমন প্রবাদবাক্যের সঙ্গে পরিচিত প্রায় এই উপমহাদেশের সকলেই। কিন্তু হঠাৎ অচেনা কেউ যদি এসে উপস্থিত হয় আপনার দরজায়? সত্যিই কি তাঁকে অতিথি হিসাবে বরণ করে নিতে পারবেন? জায়গা করে দিতে পারবেন নিজের বাড়িতে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তরটা আসার কথা ‘না’। আর সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই অসম্ভবকেই নিজের দৈনিক রুটিন বানিয়ে ফেলেছিলেন প্যারিসের বাসিন্দা। সারা পৃথিবীকেই করে তুলেছিলেন নিজের বৃহত্তর পরিবার। যা ভাবতে পারাও একার্থে অসম্ভব...
আরও পড়ুন
একসময় আবর্জনা থেকে কুড়োতেন খাবার, আজ টরেন্টোর মাস্টারসেফ চেন্নাইয়ের ব্যক্তি
Powered by Froala Editor