'পবিত্র' ঝর্নায় ছুড়ে-দেওয়া খুচরো ব্যবহৃত হয় দুঃস্থদের সাহায্যে, কোথায়?

গঙ্গাবক্ষে লঞ্চ কিংবা নৌকায় পাড়ি দেওয়ার সময় অনেকেই খুচরো পয়সা ছুঁড়ে দেন নদীর জলে। তাছাড়া বিভিন্ন নদী-তীরবর্তী তীর্থস্থানেও দেখা যায় এই দৃশ্য। গঙ্গাবক্ষে মুদ্রা-বিসর্জন ভাগ্য ফেরায়— এমনটাই বিশ্বাস মানুষের। তবে শুধু ভারতই নয়, ইতালির মতো পাশ্চাত্যের দেশেও দেখা মেলে এহেন দৃশ্যের। 

রোমের (Rome) কিংবদন্তি ট্রেভি ফাউনেন (Trevi Fountain)। ১৭৬২ সালে নির্মিত এই আশ্চর্য স্থাপত্য রোমের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিদিনই এই ঝর্না পরিদর্শনে হাজির হন লক্ষাধিক পর্যটক। ঝর্নার জলে ফেলে যান খুচরো মুদ্রা। হ্যাঁ, এটাই রীতি ট্রেভির। ইতালি সরকারের রিপোর্ট বলছে, বছরজুড়ে ট্রেভি ফাউন্টেনে নিক্ষিপ্ত মুদ্রার মোট অর্থমূল্য ১০ লক্ষ ইউরো। বা ভারতীয় মুদ্রায় ৮ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। প্রশ্ন থেকে যায়, কার পকেটে ঢোকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ?

দড়িতে চুম্বক বেঁধে গঙ্গাবক্ষ থেকে নিক্ষিপ্ত কয়েন তুলতে দেখা যায় বহু কিশোর-কিশোরীকে। তবে রোমের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। ঐতিহাসিক এই স্থাপত্য স্পর্শ করা বা ঝর্নার জলে নামা সেখানে আইনবিরুদ্ধ। ফলে, ঝর্না থেকে কয়েন কুড়নোর সাহস পান না কেউ-ই। অথচ, দিনের পর দিন ঝর্নার জলে কয়েন পড়তে থাকলেও যে উপচে উঠবে এই ঝর্না। এই সমস্যা সমাধানে শেষ পর্যন্ত ত্রাতা হয়ে ওঠে ইতালির ক্যাথলিক গির্জা পরিচালিত ‘ক্যারিটাস’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের এই উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেয় ইতালি প্রশাসনও 

প্রতি মাসেই একবার করে কয়েন সংগ্রহ করা হয় এই ঝর্না থেকে। এই কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মীও রয়েছে রোমে। প্রথমে ঝর্নায় নেমে ঝাড়ু দিয়ে একত্রিত করা হয় নিক্ষিপ্ত কয়েন। তারপর সাকশন পাইপের মাধ্যমে তা তুলে আনা হয় উপরে। অবশ্য ইতালির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি এই মুদ্রা সংগ্রহ করলেও, তা জায়গা পায় না ইতালি রাজকোষ বা গির্জার অর্থভাণ্ডারে। বরং, শহরের দরিদ্র মানুষদের খাদ্য-বস্ত্র ও বাস্থানের বন্দোবস্ত করা হয় এই অর্থ দিয়ে। 

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন বাসস্থানের বন্দোবস্ত। রোমের বুকেই রয়েছে ‘ক্যারিটাস’ পরিচালিত একটি বিশেষ প্যান্ট্রি। তাছাড়া গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র, দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহের সুপারমার্কেটও বানিয়েছে এই সংস্থাটি। রোমের উপকণ্ঠে রয়েছে ক্যারিটাস পরিচালিত একটি নার্সিংহোম। মূলত দরিদ্র এবং গৃহহীনদেরই চিকিৎসা হয় সেখানে। আর এই সবটাই চলে ঝর্নার নিক্ষিপ্ত মুদ্রাতেই। 

১৭৩০-এর দশকে এই ঝর্না নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছিলেন নিকোলা সালভি। সে-সময় এই ঝর্নাকে পবিত্র বলেই মনে করতেন ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী মানুষরা। রোমান সমুদ্র-দেবতার মূর্তির সামনে নিক্ষেপ করে যেতেন অর্থ। অনেকটা দক্ষিণার মতোই। পরবর্তীতে যা রীতি হয়ে দাঁড়ায় ট্রেভির। আবার বিদেশি পর্যটকদের বিশ্বাস, ট্রেভি ঝর্নায় মুদ্রা নিক্ষেপ করলে নাকি দ্বিতীয়বার রোম-ভ্রমণের সুযোগ মেলে জীবনে। ১৯৫৪ সালে এই আশ্চর্য প্রথাকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয় একটি আস্ত সিনেমা। ‘থ্রি কয়েনস ইন দ্য ফাউন্টেন’-খ্যাত অস্কারজয়ী এই সিনেমা মুক্তির পর এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছিল ঝর্নায় নিক্ষিপ্ত মুদ্রার পরিমাণ। তাতে আখেরে ভাগ্য ফিরেছে শহরের দরিদ্রদের, তাতে আর সন্দেহ কী? 

Powered by Froala Editor