“আমদের একান্নবর্তী পরিবার। তাছাড়াও কলকাতায় বহু আত্মীয় রয়েছে আমাদের। বছর কয়েক আগে আমার ঠাকুমা মারা যান। তবে এতো বড়ো পরিবার থাকা সত্ত্বেও ঠাকুমার শেষকৃত্যের আয়োজন করতে একাধিক সমস্যায় পড়েছিলাম আমরা। কারণ সেসময় একটা মানসিক চাপ, ট্রমা কাজ করছিল সকলের মধ্যেই। সেটা কাটিয়ে নির্ভুলভাবে সব নিয়ম মেনে আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের এত বড়ো পরিবার থাকা সত্ত্বেও যখন আমরা পারছি না সবটা সামলাতে, তবে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যরা কী করবে?”
বলছিলেন ‘জীবন সন্ধ্যা’ সংস্থার কর্ণধার মুদিত চৌধুরী। কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। মৃতদেহ সৎকার থেকে শুরু করে প্রথাগত অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত— পরলৌকিক কর্মের সমস্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বই সামলাচ্ছে ‘জীবন সন্ধ্যা’ সংস্থা।
একটা সময় পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনই হোক কিংবা ব্যবস্থাপনা— অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই সবকিছুর দায়িত্ব তুলে নিতেন আত্মীয়রা। সত্তর-আশি তো বটেই, নব্বইয়ের দশকেও এমন ছবিই ফুটে উঠত কলকাতায়। তবে সময় বদলেছে। ব্যস্ততা বেড়েছে মানুষের। ধীরে ধীরে আমরা পরিচিত হয়েছি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কথাটির সঙ্গে। বিবাহ, জন্মদিন কিংবা অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলির দায়িত্ব আজকাল বর্তায় তাঁদের ওপরেই। কিন্তু মৃত্যু-পরবর্তী অনুষ্ঠান? এই কঠিন সময়ে পাশে পাওয়া যায় না কাউকেই। আর সেই কথা চিন্তা করেই পথে নেমেছেন মুদিত চৌধুরী।
আসলে নিজেও যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। তাই আরও বেশি করে বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের অসহায়তাকে। “মানুষের ব্যস্ততার বিষয়টি তো রয়েইছে। পাশাপাশি অনেকেই কলকাতার বাইরে থাকেন। এখানে শুধুমাত্র পরিচারিকার ভরসায় থাকেন তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মা। দূর থেকে কলকাতায় দ্রুত ফিরে সমস্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এক প্রকার তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়”, উঠে আসছিল মুদিতবাবুর কথায়। একা হাতে অনুষ্ঠান আয়োজন তো দূরের কথা, কেউ কেউ হয়তো শেষবারের জন্য দেখতেও পারেন না প্রিয়জনকে।
আরও পড়ুন
‘অস্পৃশ্য’ রানি-কে ডুবন্ত দেখেও বাঁচাল না কেউ; সাড়ম্বরে পালিত হল অন্ত্যেষ্টি
তাই মৃতদেহ সৎকারই হোক কিংবা দেহ-সংরক্ষণ— সবকিছুর জন্যই ব্যবস্থা করে রেখেছে ‘জীবন সন্ধ্যা’। তাঁদের যেমন রয়েছে শববাহী গাড়ি, তেমনই রয়েছে প্রিজার্ভেশন বক্স। ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত এই বাক্সেই অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায় মৃতদেহ। না, কোনো মর্গ নয়। মৃতের বাড়িতেই এই ব্যবস্থা করে দেন তাঁরা। মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পরে পৌরসভায় গিয়ে তাঁরাই এনে দেব ডেথ সার্টিফিকেটও।
এখানেই শেষ নয়। সৎকারের পর স্বজনভোজন থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচার-প্রক্রিয়া তার জন্যেও রয়েছে বন্দোবস্ত। “প্রত্যেকের ধর্মীয় আচার আলাদা। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন— সমস্ত ধর্মের জন্যই আলাদা আলাদা করে ভেবেছি আমরা। আবার অনেক সময় ধর্ম এক হলেও রীতি-রেওয়াজ ভিন্ন হয় বিভিন্ন পরিবারে। সেক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গেও কথা বলে তাঁদের মতো করে ব্যবস্থাপনা করে দিই আমরা”, জানালেন মুদিত চৌধুরী। হ্যাঁ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষেই সকল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন
রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের মৃত্যুস্মারক উদ্ধার, জানা যাবে বিজয়নগরের অজানা ইতিহাস
শেষকৃত্যের পুরো প্রক্রিয়ার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা প্যাকেজ। চাইলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটারই দায়িত্ব তাঁদের ওপরে বর্তে দিতে পারেন। ন্যূনতম প্যাকেজ রয়েছে ৬০ হাজারের। তবে আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যা বাড়লে, বাড়বে খরচ। আবার চাইলে কেবলমাত্র কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ার জন্যও আলাদাভাবে দায়িত্ব দিতে পারেন ‘জীবন সন্ধ্যা’-কে। রয়েছে সেই সুবিধাও।
গত বছর থেকেই এই অভিনব উদ্যোগ শুরু করেছিলেন মুদিতবাবু। তবে মহামারীর কারণে সেভাবে পরিষেবা দিতে সক্ষম হননি তিনি। চলতি বছরের শুরু থেকেই সম্পূর্ণভাবে কাজ করা শুরু করেছে ‘জীবন সন্ধ্যা’। ইতিমধ্যেই বহু পরিবারের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। তবে এখনও পর্যন্ত এই পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে শুধু কলকাতার মধ্যেই। আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সারা ভারতেই এই পরিষেবা দেওয়ার পরিকল্পনা মুদিতবাবুর। প্রিয়জনের শেষ বিদায়ে শান্তিকামনায় যাতে বিন্দুমাত্র খামতি না থাকে, সেটাই একমাত্র লক্ষ্য। এমবিএ করেও তাই বহুজাতিক সংস্থার মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে বেছে নিয়েছেন এমন একটি পথ…
আরও পড়ুন
চূড়ান্ত বিরোধ ঠাকুরবাড়িতে; দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ-শান্তি নিয়ে বিভক্ত সমগ্র পরিবার
Powered by Froala Editor