পেশায় হোক কিংবা নেশায়, ছবি যাঁরা তুলতে ভালোবাসেন, তাঁরা ফটোগ্রাফি-কেই উৎসর্গ করেন জীবনের অনেকটা সময়। ডিএসএলআর কিংবা মোবাইলে ফটো তোলার চল খুব বেশিদিনের নয়। এর আগে রাজত্ব করেছে ফিল্ম ক্যামেরাই। অসংখ্য ফটোগ্রাফার খ্যাতি পেয়েছেন ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তুলে। বাঙালিদের মধ্যেও, ছবি তোলার চল শুরু হয়ে গিয়েছিল উনিশ শতকেই। স্টুডিও ও ফটোগ্রাফারের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না।
আরও পড়ুন
এখনও ক্যামেরা ছাড়েননি বীরভূমের প্রথম প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার
কিন্তু, ইংরেজ আমলে বাঙালি মহিলারাও যে ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন, এই তথ্যটি আমাদের অনেকেরই অজানা। তখন পরিস্থিতিটা ছিল এমন – অভিজাত পরিবারের মহিলারা পালকি করে আসতেন ফোটো তুলতে। পালকি থেকে নামতেন তাঁরা। দাসীরা তাঁদের স্টুডিও দেখিয়ে দিত। স্টুডিও-তে গিয়ে তাঁরা চেয়ারে বসতেন। লেন্স তৈরি করাই থাকত। ফটোগ্রাফারের নির্দেশে কোনো মহিলা সহযোগী তাঁদের ফোটো তুলে দিতেন। তারপর তাঁরা আবার পালকিতে চেপে অদৃশ্য হয়ে যেতেন।
১৮৫৭ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে ২৩ জনের নাম নথিভুক্ত ছিল। পরের বছর সংখ্যাটা বেড়ে গিয়ে হয় ৮৮, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ৪ জন মহিলা ফটোগ্রাফার।
এই সমস্যা সমাধানের তখন একটাই পথ ছিল। মহিলা ফটোগ্রাফার দিয়েই মহিলাদের ফোটো তোলার ব্যবস্থা করা। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য নামটি হল মিসেস ই মেয়ার। ৭ নম্বর ওল্ড কোর্ট স্ট্রিট হাউসে তিনি একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমেই তিনি ভারতীয় অভিজাত মহিলাদের দিলেন এক সুবর্ণ সুযোগ। সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হয়ে নিজেদের ছবি তোলাতে পারবেন তাঁরা। সাধারণদের থেকে নিজেদের গোপন রাখার জন্য পালকির আবরণ আর দরকার পড়ল না।
১৮৫৭ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের বার্ষিক সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী, তাঁদের সোসাইটিতে ২৩ জনের নাম নথিভুক্ত ছিল। পরের বছর সংখ্যাটা বেড়ে গিয়ে হয় ৮৮, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ৪ জন মহিলা ফটোগ্রাফার। এঁদের মধ্যে তিনজন ছিলেন মিসেস মেয়ার, মিসেস টি থমসন ও মিসেস সি বি ইয়ং।
১৮৬৪ সালে মিসেস ই মেয়ার তাঁর স্টুডিও ৫ নম্বর ওয়াটারলু স্ট্রিটে স্থানান্তরিত করেন। সোসাইটির জার্নাল অনুযায়ী, ১৮৭৭ সালে মিসেস ডি গ্যারিক ওয়াটারলু স্ট্রিটে জেনানা স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও খুব শীঘ্রই তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৮৯২ সালে লালা দীনদয়াল হায়দ্রাবাদে জেনানা স্টুডিও চালু করেন। তিনি বলেন যে, এই স্টুডিও কেবল দেশীয় মহিলাদের ফটো তোলার জন্য। এছাড়া সাধারণ মানুষের থেকে মহিলাদের আড়ালে রাখার জন্য স্টুডিও-তে বিশেষ ব্যাবস্থাও ছিল। বড়ো পাঁচিলে ঘেরা এই স্টুডিও তে মিসেস কেনি লেভিক তার সহকারীদের নিয়ে অভিজাত মহিলাদের ফোটো তুলতেন।
ডালহৌসি স্ট্রিটের ঠিকানা সহ বিবি উইন্সের নাম ও ফটোগ্রাফি শেখানোর বিজ্ঞাপনটি বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।
এরপর ইতিহাসের পাতায় পদার্পণ করেন বিবি উইন্স। ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারা তিনি যথেষ্ট অনুপ্রাণিত ছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজকে স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হতে দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন শুধু দেশীয় মহিলাদের ফোটোই তুলবেন না তিনি, তাঁদের ফটোগ্রাফিও শেখাবেন। ডালহৌসি স্ট্রিটের ঠিকানা সহ তাঁর নাম ও ফটোগ্রাফি শেখানোর বিজ্ঞাপনটি বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।
কিন্তু এসব তো বিদেশিনীদের উদ্যোগ। দেশীয় মহিলাদেরও উৎসাহ কম ছিল না ফটোগ্রাফি ঘিরে। সমস্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে ভারতীয় মহিলা সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফি শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তিনি হলেন মহারানি মনমোহিনী, ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের তৃতীয় স্ত্রী। মহারাজা নিজেও ছবি বিশারদ ছিলেন। স্ত্রীকেও উৎসাহ দিতেন ফটোগ্রাফি-তে। তাঁর তত্ত্বাবধানেই মনমোহিনী দেবী ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন। শুধু ফটো তোলাই নয়, তা ডেভেলপও করতেন তিনি নিজেই।
এরপর যাঁর নাম আসে তিনি হলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। উনিশ শতকে ঠাকুরবাড়ির মহিলারা যে ফটোগ্রাফি চর্চা করতেন তা রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস পড়লেই বোঝা যায়। শোনা যায়, বাড়ির বয়স্কদের ছবিও তুলতেন তিনি। এও সম্ভব, রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর যে একটিমাত্র ফটোগ্রাফ এখনও পাওয়া যায়, তা হয়তো তাঁরই তোলা। যদিও এ-বিষয়ে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
সরোজিনী ঘোষ-ই প্রথম বাঙালি মহিলা, যিনি নিজের স্টুডিও খুলেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকায় তাঁর স্টুডিও-র বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল – ‘দ্য মহিলা আর্ট স্টুডিও অ্যান্ড ফটোগ্রাফিক স্টোর’।
ফটোগ্রাফি চর্চা তো করছেন অনেকেই, কিন্তু সরোজিনী ঘোষ-ই প্রথম বাঙালি মহিলা, যিনি নিজের স্টুডিও খুলেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকায় তাঁর স্টুডিও-র বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল – ‘দ্য মহিলা আর্ট স্টুডিও অ্যান্ড ফটোগ্রাফিক স্টোর’। ৩২, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের এই স্টুডিও বাঙালি মহিলাদের ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহের নিদর্শন।
ফটোগ্রাফির ইতিহাসে আরেক উল্লেখযোগ্য নাম হল অন্নপূর্ণা দত্ত। ১৮৯৪ সালে জন্মান তিনি। পিতা ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক ও লেখক। মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে উপেন্দ্রনাথ দত্তের বিবাহ হয়। পেশায় উকিল হলেও উপেন্দ্রনাথ ছিলেন চিত্রশিল্পী। ফটোগ্রাফির নেশাও ছিল তাঁর। তাঁর সৌজন্যেই ফটোগ্রাফি শুরু অন্নপূর্ণা দত্তের। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি পেশাদার ফটোগ্রাফির কাজ করেছিলেন তিনি। সরোজিনী ঘোষের মত ফোটো স্টুডিও না থাকলেও, তিনিও স্বহস্তেই ফটো ডেভেলপ ও প্রিন্ট করতেন।
আরও পড়ুন
ট্রিগার থেকে শাটারে - এক রঙিন মানুষের বেরঙিন মৃত্যু
ফটোগ্রাফির কথা যখন বলাই হচ্ছে, তখন মীরা চৌধুরী ও ইন্দিরা দেবীর কথা না বললেই নয়। সেকালের বিখ্যাত ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রলাল মৈত্রের কন্যাদ্বয় এঁরা। দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মায়ো হসপিটালের কাছে তাদের কোয়ার্টারে প্রায়ই আসতেন সুকুমার রায়, অতুলপ্রসাদ সেন প্রমুখ। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর দুই কন্যাকেই ফটোগ্রাফি-তে উৎসাহ দিয়েছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়স থেকে ফোটো তোলা শুরু করেন তাঁরা। মীরা দেবীর তোলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে তাঁর অটোগ্রাফও আছে।
পেশাদার ফটোগ্রাফার না হলেও, তাঁর ছবিতে ফুটে উঠেছে কলকাতার আসল ছবি। ফটোগ্রাফির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছিল দেশভাগের পর কলকাতায় আসা শরণার্থীরা। রেললাইনের পাশে কুঁড়েঘরে থাকা মানুষেরা। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের কলকাতাও রয়েছে তাঁর ফটোগ্রাফিতে।
এরপর যার নাম আসে তিনি হলেন অন্নপূর্ণা গোস্বামী। ১৯১৬ সালে জন্ম তাঁর। পিতা নিতিশচন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন কলম্বিয়া পিকচার্সের জেনারেল ম্যানেজার। পেশাদার ফটোগ্রাফার না হলেও, তাঁর ছবিতে ফুটে উঠেছে কলকাতার আসল ছবি। ফটোগ্রাফির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছিল দেশভাগের পর কলকাতায় আসা শরণার্থীরা। রেললাইনের পাশে কুঁড়েঘরে থাকা মানুষেরা। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের কলকাতাও রয়েছে তাঁর ফটোগ্রাফিতে। তবে ফটোগ্রাফিই একমাত্র পরিচয় নয় তাঁর। 'রেললাইনের ধারে' ও 'একফালি বারান্দা' তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪০ সালে ফটোগ্রাফার হিসেবে খ্যাতি পান দেবলীনা সেন রায় ও মনবীণা সেন রায়। ইলাস্ট্রেটেড ডেইলিতে নিয়মিত তাঁদের তোলা ছবি ছাপা হত। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় 'টোয়েন্টি ফাইভ পোট্রেটস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর'। এর মধ্যে পুরীতে থাকাকালীন কবির ছবিও ছিল। তাঁদের প্রথম ফটোগ্রাফ বেরোয় 'সচিত্র ভারত' জার্নালে।
আরও অনেকেরই নাম করা যায়। কেউ কেউ খ্যাতি পেয়েছেন, কেউ আবার হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালে। কিন্তু বাঙালির ফটোগ্রাফি চর্চার ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে এই নারীদের উপেক্ষা করার উপায় নেই। নিজেদের উৎসাহে ও অপরের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যামেরাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁরা। ইতিহাস তাঁদের ভুলবে না।
তথ্য ও চিত্র ঋণ - quod.lib.umich.edu