গ্রিনউইচ গড় সময় বা শূন্য মেরিডিয়ানের থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা এগিয়ে রয়েছে ভারত। এমনটা ধরে নিয়েই পরিগণিত হয় ভারতের প্রমাণ সময়। এবং গোটা ভারতবর্ষের সমস্ত অঞ্চলেই সময় নির্ধারিত হয় এই পদ্ধতির ওপর ভর করেই। ধরুন, কলকাতায় বসে আপনি কথা বলছে মুম্বাই শহরে থাকা কোনো বন্ধুর সঙ্গে— দু’জনেরই ঘড়ি জানান দেবে একই সময়। তবে দশক আটেক আগেও ভারতের ছবি এমনটা ছিল না। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে কলকাতা আর মুম্বাইতে নির্ধারিত সময় ছিল পুরোপুরি আলাদা। কলকাতায় ছিল আলাদা স্বতন্ত্র ‘টাইম জোন’।
তবে এর পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে সময়ের এক না বলা ইতিহাস। আঠারো শতক অবধি, এমনকি উনিশ শতকের শুরুতেও ভারতে ঘড়ির চল ছিল না সেইভাবে। আঞ্চলিক সময় নির্ধারিত হত মধাহ্নের ওপর নির্ভর করে। দিবালোক নির্ভর সেই সময় ব্যবস্থায়, সূর্য মাথার ওপর থাকলে ধরে নেওয়া হত দুপুর ১২টা। আর তার ভিত্তিতেই হত ২৪ ঘণ্টার বিভাজন।
তবে ধীরে ধীরে পরিধি বাড়ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। আর প্রমাণ সময় না থাকায় প্রশাসনিক কাজে তৈরি হচ্ছিল অসঙ্গতি। সেই অসঙ্গতি দূর করতেই ১৮০২ সালে ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমার জন গোল্ডিংহাম সারা ভারতের জন্য একটি বিশেষ সময়বিধি বেঁধে দেন। মাদ্রাসের সময়কে প্রমাণ ধরে সময় গণনা শুরু হয় ভারতীয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশের। যা বর্তমান ভারতীয় প্রমাণ সময়ের থেকে পিছিয়ে ছিল ৯ মিনিট।
এরও প্রায় ৮ দশক পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ও অঞ্চলের সময়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে জন্ম নেয় গ্রিনউইচ গড় সময়। সারা পৃথিবীকে ভেঙে নেওয়া হয় ৩৬০টি দ্রাঘিমাংশে। যেখানে প্রতি দ্রাঘিমার অন্তরে সময়ের অন্তর ৪ মিনিট। ব্রিটেনের গ্রিনউইচ শহরের দ্রাঘিমাকে ০ ডিগ্রি ধরে অন্যান্য অঞ্চলের সময় নির্ধারণ করার পদ্ধতি শুরু হয়। দেখা হত আঞ্চলিক সময় গ্রিনউইচের থেকে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে রয়েছে। সময়টা ১৮৮৪।
আরও পড়ুন
উল্কাপাতে আলোকময় আকাশ, রবিবার রাতে সাক্ষী থাকবে কলকাতাও
এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী সাড়ে ৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমার ব্যবধানে তৈরি হয় ৩০ মিনিটের সময়ের ব্যবধান। আর ভারতের (অখণ্ড ভারতের) দুই প্রান্তের মধ্যে এর ব্যবধান প্রায় ৩৯ ডিগ্রি। সেজন্যই প্রয়োজন পড়ে ভারতীয় সময়কে বেশ কয়েকটি প্রমাণ সময়ে ভেঙে নেওয়ার। অন্যদিকে মাদ্রাযের অবস্থান ছিল ভারতের দুই প্রান্তের অনেকটা মাঝামাঝি। ফলে নতুন করে দুটি শহরের সময়কে বেছে নেওয়া হল ভারতীয় সময়ের প্রমাণ হিসাবে। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলের রাজধানী ছিল কলকাতা, আর বাণিজ্য নগরী হিসাবে সেইসময়ও আজকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বোম্বে। প্রচলন হল কলকাতা এবং বোম্বে স্ট্যান্ডার্ড টাইমের। দুই শহরের সময়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৩৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ড।
তবে বলাইবাহুল্য, দীর্ঘস্থায়ী হল না এই নতুন সময়বিধিও। রেলের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের সমন্বয়-সাধনই হয়ে উঠল জটিলতার কারণ। দু’ধরণের সময়ের হিসেবের চোটে গণ্ডগোল হতে থাকল আন্তর্রাজ্য রেল পরিষেবা এবং টেলিগ্রাফে। তৎকালীন ভাইস রে লর্ড কার্জন জানালেন, গোটা ভারতের জন্য নির্ধারিত হবে একটিই প্রমাণ সময়, যদি দুই শহরের নাগরিকরা রাজি থাকেন। তবে খুব সহজ ছিল না এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। একদিকে ফিরোজশাহ মেহেতার মতো মধ্যপন্থী নেতারা সমর্থন জানিয়েছিলেন কার্জনকে। তেমনই অন্যদিকে লোকমান্য তিলক ও অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বেছে নিয়েছিলেন আন্দোলনের পথ। ‘বঙ্গভঙ্গ’ বিভাজনের আবহে আরও একটা বিভাজনের সাক্ষী থেকেছিল ভারত।
শেষ অবধি ক্ষমতার প্রয়োগ করে কার্জনই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে ভারতে শুরু হয় আইএসটি বা ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম। এলাহাবাদের মির্জাপুরের সময়কে প্রমাণ ধরে নেওয়া হয়। যা গ্রিনউইচের থেকে ঠিক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে। তৈরি হয় প্রমাণ ‘ক্লক টাওয়ার’-ও। তবে আইএসটির প্রচলন শুরু হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন ধরেই ক্যালকাটা টাইম জোন এবং বোম্বে টাইম জোনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন দুই শহরের নাগরিকরা। স্বাধীনতার পরেও প্রচলিত ছিল এই সময়বিধিই। কলকাতা ১৯৪৮ এবং মুম্বাই ১৯৫৫ সাল অবধি মান্যতা দিত এই সময়কেই।
তবে এখানেই শেষ নয়। ১৯৫৫-র অবলুপ্তির পর এই সময়বিধি আবার ফিরে এসেছিল ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময়। অসামরিক ক্ষেত্রে শক্তির খরচ কমাতে দিনের আলোর সর্বাধিক ব্যবহারের জন্য এমন নীতি নিয়েছিল ভারত সরকার।
আরও পড়ুন
এখনও অনিশ্চিত কলকাতা বইমেলার ভবিষ্যৎ, কী ভাবছেন প্রকাশকরা?
পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম ভারত। বর্তমানে পশ্চিমের গুজরাট থেকে পূর্বের অরুণাচল পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। ব্যবধান ৩০ ডিগ্রির। ফলে পূর্বের রাজ্যগুলিতে যেমন তাড়াতাড়ি সূর্যোদয় হয়। তেমনই সূর্যাস্তও হয় দ্রুত। যার কারণে নষ্ট হয় দিবালোকের অধিকাংশ সময়। যা পারতপক্ষে একদিকে যেমন শক্তির খরচ বাড়িয়ে দেয়, তেমনই অন্যদিকে কমিয়ে দেয় দেশের গড় শ্রমকেও। প্রভাব ফেলে জিডিপিতে। এই সমস্যা দূর করতে আসামের একাধিক অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে ‘চায়ে বাগান টাইম জোন’-এর। কেননা, ভারতীয় প্রমাণ সময় অনুযায়ী চা-বাগান কর্মীদের কাজ করা অনেকটা কঠিন হয়ে ওঠে।
তবে সময়ের এই বৈষম্য কাটাতে বারবার আবেদন উঠেছে আইএসটির পরিবর্তে পুরনো বিভাজিত আঞ্চলিক সময়কেই প্রাধান্য দেওয়ার জন্য, একাধিক প্রমাণ সময়ের সাহায্য নেওয়ার জন্য। এমনকি একুশ শতকে দাঁড়িয়েও এই প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় বিকল্প পরিকাঠামো বা পরিকল্পনার হদিশ দিতে পারেননি কেউ-ই। সেই জায়গাটা ভবিষ্যতে পাকা হলে আবারও হয়তো কলকাতা স্ট্যান্ডার্ড টাইম চালু হতে পারে ভারতে। আবার হয়তো ছুঁয়ে যেতে পারে শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস...
Powered by Froala Editor