মোটা শিকল, তালা দিয়ে বন্ধ দরজা। ভেতর থেকে বন্ধ জানলা। বাইরে থেকে প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে তার একাংশ। সেই জানলা ভেঙেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন পুলিশের আধিকারিকরা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেইসঙ্গে দুর্গন্ধে টিকে থাকাই দায়। যেন দীর্ঘদিন ধরে কোনো মৃতদেহ পচেছে সেখানে। তবে টর্চের আলো জ্বালতে যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাঁদের, তা কল্পনা করা যায় না স্বপ্নেও। খাটের ওপর শুয়ে আছেন এক শীর্ণকায়, কঙ্কালসার চেহারার মহিলা। লোহার শিকল দিয়ে খাটের সঙ্গে বাঁধা তাঁর হাত-পা। তাঁর সারা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইঁদুর।
১৯০১ সালের মে মাস। এক রহস্যময় চিঠি পান প্যারিসের (Paris) অ্যাটর্নি জেনারেল লিওন বুলোট। না, চিঠির ওপরে প্রেরকের নাম নেই কোনো। নেই পোস্টাল স্ট্যাম্পের দাগও। কেউ যেন খুব গোপনীয়তা সহকারেই এই চিঠি ফেলে দিয়ে গেছেন তাঁর অফিসের লেটার বক্সে। বাহ্যিকভাবে এই চিঠি যতটা না আকর্ষণীয়, তার থেকেও বেশি রহস্যময় এই চিঠির বিষয়বস্তু। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্যারিসের মোনিয়ের পরিবারের প্রাসাদোপম বাড়িতে কয়েদ করে রাখা হয়েছে এক অজ্ঞাত পরিচয় মহিলাকে। প্রাথমিকভাবে চিঠিটিকে ততটাও গুরুত্ব দেননি বুলোট। প্যারিসের অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবার আবার এমন কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে নাকি? আর তা যদি হয়েও থাকে, তবে সরাসরি সে-বাড়িতে পুলিশ পাঠালে যদি ওপর মহল থেকে শাস্তির মেঘ ঘনিয়ে আসে তাঁর ওপর? আর যদি এই সংবাদ সত্যি হয়? এমন ঘটনার তদন্ত করে দেখাটাই তো তাঁর কর্তব্য সেক্ষেত্রে। নিজের সঙ্গে বেশ কিছুদিন এই যুদ্ধ চলেছিল বুলোটের। তারপর মনিয়ের-এস্টেটে পুলিশ পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন তিনি। প্রকাশ্যে আসে সেই ভয়াবহ দৃশ্য। কিন্তু কে এই মহিলা? কেন-ই বা বন্দি করে রাখা হয়েছে তাঁকে?
ঘুপচি, অন্ধকার ঘরে বন্দি থাকা এই মহিলাটির নাম ব্ল্যাঙ্কা মনিয়ের (Blanche Monnier)। হ্যাঁ, তিনি প্যারিসের এই সম্ভ্রান্ত পরিবারেরই এক সদস্যা। আর তাঁকে এই ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন স্বয়ং তাঁর মা, মাদাম মনিয়ের। আসলে ব্ল্যাঙ্কার এই গল্প চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটের থেকে কম নয় কোনো অংশেই।
শুরু থেকেই বলা যাক গল্পটা। উনিশ শতকের সত্তরের দশক। ফ্রান্স তো বটেই, সে-সময় গোটা ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দরী হিসাবেই মনে করা হত ব্ল্যাঙ্কাকে। কখনও কখনও তাঁর ছবিও ছাপা হত খবরের কাগজে। বাবা মারা গিয়েছিল আগেই। প্রিয়জন বলতে কেবলমাত্র মা। বাবার অবর্তমানে পারিবারিক ব্যবসাও ক্রমে ঢলছিল ক্ষতির দিকেই। তবে রূপের গুণেই পরিবারের ‘সম্ভ্রান্ত’ তকমা জিইয়ে রাখেন ব্ল্যাঙ্কা।
মেয়ের সৌন্দর্য নিয়ে গর্ব কম ছিল না মাদামেরও। এমনকি মেয়ের সৌন্দর্যকে হাতিয়ার করেই নিজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। মেয়ের জন্য দেখাশোনা করে ঠিক করেছিলেন প্রতিপত্তি-ওয়ালা জামাই। পারিবারিক ব্যবসা ধ্বসে পড়লে জামাই-এর টাকাতেই সংসার চলবে তাঁর, এই ছিল পরিকল্পনা। তবে শেষমেশ সব পরিকল্পনাতেই জল ঢেলে দিলেন তাঁর কন্যা।
১৮৭৬ সাল। বিয়ের জন্য পাত্র নিশ্চিত করার ব্যাপারটা ব্ল্যাঙ্কাকে জানান মাদাম। তবে উচ্ছ্বাসের বদলে বিয়ে করতেই বেঁকে বসেন তিনি। ব্যাপার কী? খানিক জেরার পর জানা যায়, ইতিমধ্যেই অন্য এক পুরুষের প্রেমে পড়েছেন ব্ল্যাঙ্কা। এমনকি রীতিমতো শারীরিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে তাঁদের মধ্যে। তৎকালীন প্যারিসে এ-ব্যাপারটা সমাজে গর্হিত কাজ— এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। ফলে, আর পাঁচজন মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না ব্ল্যাঙ্কার। প্রেমিক যে মধ্যবিত্ত ঘরের পুরুষ। আর তেমনটা হলে নিজের ভবিষ্যৎ কীভাবে সুনিশ্চিত করবেন মাদাম? ফলে সন্তানের এই সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেননি তিনি। এমনকি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে, মেয়েকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার পথকেই বেছে নেন মাদাম। কী সেই শাস্তি?
নিজের মেয়েকেই বন্দি করেন নিজের বাড়িতে। প্রকাণ্ড মহল। ঘরের অভাব নেই। আর সেই বাড়ির এক কোণের ছোট্ট ঘরেই নিজের মেয়েকে শিকল দিয়ে আটকে রাখেন মাদাম। এমনকি বিবস্ত্র করে দেওয়া হয় তাঁকে। একটিমাত্র জানলাও বন্ধ করে দেওয়া হয় ভেতর থেকে। বাইরে থেকে দেওয়াল গেঁথে দেওয়া হয় জানলার নিচের অংশে। দিনে একবেলা খাবার দেওয়া হত ব্ল্যাঙ্কাকে। কখনও কখনও জুটত না সেটাও। ফলে অপুষ্টিতে ক্রমে শুকিয়ে যান তিনি। পাশাপাশি অন্ধকার ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে ভিটামিন ডি-এর অভাবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে শরীরের হাড়। সেইসঙ্গে সারাদিন শিকলবন্দি থাকায়, মল-মূত্রও ত্যাগ করতে হত বিছানাতেই। দুর্গন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই দিনগুজরান করতে হত প্যারিসের অন্যতম সুন্দরীকে।
প্রাথমিকভাবে তাঁর চিৎকার শুনে মাদামের কাছে ছুটে আসতেন প্রতিবেশীরা। জিজ্ঞেস করতেন ব্ল্যাঙ্কার কথা। তবে উত্তর তৈরিই থাকত মাদামের। প্রেম ভেঙে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে সন্তান, এমনটাই জানাতেন তিনি। এর বছর কয়েকপর ব্ল্যাঙ্কা মারা গেছেন, এমনটাও ঘোষণা করেন তিনি। ঘটা করে আয়োজন করেন শেষকৃত্য, অর্থাৎ ‘ফিউনেরাল’। সমাধিস্থ করেন কফিন। কিন্তু সেই কফিনে যে ব্ল্যাঙ্কা ছিলেন না, তা বলার অপেক্ষা থাকে না।
এর প্রায় ২৫ বছর পর প্রকাশ্যে আসে মাদাম মনিয়েরের এই নৃশংসতার কাহিনি। বেনামী চিঠি মারফত খবর পৌঁছায় প্যারিসের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে। পরের গল্পটা তো বলা হয়েছে আগেই। ব্ল্যাঙ্কাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁর ওজন মাত্র ২৫ কিলোগ্রাম। শরীরে বাসা বেঁধেছে একাধিক রোগ। সম্পূর্ণ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন তিনি। প্যারিসের এক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। আরও ১২ বছর বেঁচে থাকার পর ১৯১৩ সালে ৬৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন ব্ল্যাঙ্কা। অন্যদিকে গ্রেপ্তার করা হয় মাদামকে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লাভ জিহাদ বা অনার কিলিং-এর মতো শব্দবন্ধ প্রায়শই দেখা যায় এ-দেশের সংবাদমাধ্যমে। তা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনাও করে পশ্চিমী দুনিয়া। আওয়াজ তোলে ব্যক্তি স্বাধীনতা, বৈষম্য নিয়ে। অথচ, আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে প্যারিসে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাকেও কি এই একই শ্রেণিতে গণনা করা উচিত নয়? মনিয়ের পরিবারের এই মর্মান্তিক কাহিনি আজও প্রচলিত প্যারিসের মানুষের মুখে মুখে। নৃশংসতার নিরিখে যা হার মানায় সিনেমাকেও…
Powered by Froala Editor