অপরাধের জীবন থেকে অপরাধীর খোঁজে, যেভাবে জন্ম বিশ্বের প্রথম 'আধুনিক' গোয়েন্দার

একজন তুখোড় গোয়েন্দা আর একজন চতুর অপরাধীর মধ্যে তফাৎ ঠিক কোথায়? নিশ্চয়ই নৈতিকতার প্রসঙ্গে। ধুরন্ধর বুদ্ধির সাহায্যে অপরাধী সুচারুভাবে সম্পন্ন করে নিজের কাজ, চেষ্টা করে কোনো ফাঁকফোকর না রাখার। আর গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী শক্তিতে ক্রমশ জালে বন্দি করতে থাকে সেই অপরাধীকে। মনে পড়তে পারে সত্যজিৎ রায়ের ‘বাক্স রহস্য’-এর কথা। একটা ব্যাগ চুরি করে ফেলুদা তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন লালমোহন বাবুকে। সৌভাগ্য যে, ফেলুদার মতো মানুষ শুভবুদ্ধির দলে, নাহলে কিন্তু খুব মুশকিল হত তাঁর অপরাধকে চিহ্নিত করা। কিন্তু, বাস্তবে এমন চরিত্রও আছেন, যিনি কুখ্যাত অপরাধীর তকমা ছেড়ে পরে হয়ে উঠেছিলেন আদর্শ গোয়েন্দা (Detective)। এমনকি অপরাধতত্ত্বের বহু খুঁটিনাটির আবিষ্কর্তাও তিনি। যাঁর চরিত্রকে অবলম্বন করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য রহস্যকাহিনি।

কথা হচ্ছে ফ্রান্সের (France) ইউজিন ভিদোককে (Eugene Vidocq) নিয়ে। ১৭৭৫ সালে আরাসে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম। কৈশোর থেকেই চুরির কাজে তাঁর হাত এমনভাবে পেকে ওঠে যে, সংশোধনাগারেও পাঠাতে হয় তাঁকে। তাতে অবশ্য বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। ফিরে এসে কিছুদিন ভদ্র হয়ে থাকার পর একদিন বাড়ির সমস্ত টাকাপয়সা হাত করে পালিয়ে যান তিনি। উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার পথে পাড়ি দেওয়ার। কিন্তু চোরের উপরেও বাটপাড় থাকে। সেরকমই এক ঘটনায় সর্বস্ব হারিয়ে কাজ নিতে হয় সার্কাসে। আর শুধু চুরি তো নয়, চরিত্রেও বিস্তর সমস্যা ছিল তাঁর। ফলে ঘাড়ধাক্কা খেতে হল এখান থেকেও। ১৭৯১ সাল নাগাদ পরিচয় ভাঁড়িয়ে ঢুকে পড়েন সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধবিগ্রহ তখন হামেশাই লেগে থাকত, ফলে এত কড়াকড়িও ছিল না এসবে। তার উপর তলোয়ার চালানোতে রীতিমতো পোক্ত ইউজিন। আর এখানেই দেখা মিলল তাঁর চরিত্রের আরেক অন্ধকার দিকের। কথায় কথায় লোককে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করতেন তিনি। ১৫টি যুদ্ধের মধ্যে দু’জনকে প্রাণে পর্যন্ত মেরে ফেলেন।

বিচারে কারাদণ্ড হলেও পরের বছরই অস্ট্রিয়া-প্রুশিয়া যুদ্ধের আবহে মুক্তি মেলে তাঁর। ভিতরের সমস্ত হিংস্রতা যেন উজাড় করে দিলেন শত্রুপক্ষের শরীরে। যুদ্ধের পর পদোন্নতি অবধারিত, এমন সময়ে ঝামেলায় জড়িয়ে আক্রমণ করে বসলেন সেনাপ্রধানকে। ফের পালাতে হল, ছদ্মনাম নিয়ে স্থান নিলেন দূরবর্তী এক অঞ্চলের সেনাবাহিনীতে। এইভাবে বেশ কয়েকটি জায়গায় গণ্ডগোল পাকিয়ে ফিরে এলেন জন্মভূমিতে। মাত্র আঠারো বছর বয়স তখন তাঁর। বিয়ে করলেন এক প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির কন্যাকে। আরাসে নতুন করে যে সকল কুকীর্তি করেছিলেন ইউজিন, এই ভদ্রলোক না থাকলে গিলোটিনে মৃত্যু ছিল অনিবার্য। ফলে আবার পলায়ন, আবার ছদ্মনামে সেনাবাহিনী। ১৭৯৫-এ সেনার জীবন শেষ করে থাকতে শুরু করেন প্যারিসে। প্রতিপত্তিবান মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু এবার আর পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হল না। ১৮০০ সাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে হল ফ্রান্সের বিভিন্ন জেলে। জামিনে মুক্তি পেলেও রক্তের মধ্যে ঢুকে যাওয়া অপরাধবোধ নিয়তির মতো ফিরিয়ে নিয়ে যেত অন্ধকার কারাগারে। 

অবশেষে একদিন ক্লান্তি গ্রাস করল ইউজিনকে। অপরাধীর জীবনে বারবার পালিয়ে একটা সময় সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল তাঁর। ১৮০৯ সাল নাগাদ নিজেকে সমর্পণ করলেন পুলিশের হাতে। না, আর কোনো শাস্তি দেওয়া হল না তাঁকে, বরং পূর্ব অভিজ্ঞতা আর অপরাধীর মনস্তত্ত্বকে পড়তে পারার ক্ষমতার জন্য কাজে লাগানো হল গুপ্ততথ্য সংগ্রহের কাজে। গত দশ বছরে প্যারিসের প্রায় সবকটি অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গেই যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল তাঁর। ফলে প্রতিটি তথ্য গিয়ে লাগল সঠিক নিশানায়। ১৮১১ নাগাদ পুলিশের অনুমতি নিয়ে গড়ে তুললেন বারো জনের এক বিশেষ বাহিনী। বলা যেতে পারে বিশ্বের প্রথম গোয়েন্দা সংস্থা তৈরি হল তাঁর হাতে। যা বর্তমান ফ্রান্সের গোয়েন্দা দফতর ‘সুরেতে’-র প্রাথমিক রূপ। পুলিশের চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে নতুনভাবে তাদের প্রশিক্ষণ দিলেন ইউজিন। আঙুলের ছাপ শনাক্ত করা, ছদ্মবেশ ধারণ, এমনকি ফরেনসিক বিভাগের কাজেও নিত্যনতুন পদ্ধতির খোঁজ নিয়ে এলেন তিনি। 

আরও পড়ুন
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বসেই গোয়েন্দাগিরি, বিশ্বযুদ্ধ ও পোলিশ বিপ্লবীর কাহিনি

তাদের সৌজন্যে ১৮১৭ সালে আটশো কুখ্যাত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যা অন্য বছরের চেয়ে তিন গুণ। পুরষ্কারস্বরূপ তুলে নেওয়া হয় ইউজিনের উপর থাকা সমস্ত মামলা। তাঁর পর্যবেক্ষণের সূক্ষতা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সূত্রে গুরুত্ব আরোপ, ‘কেস ফাইল’ তৈরির বিচক্ষণতা এবং সামান্য তথ্যের সাহায্যে সম্পূর্ণ অপরাধটির ছবি তৈরি করতে পারার ক্ষমতা রীতিমতো জনপ্রিয় করে দেয় তাঁকে। অবশ্য ফ্রান্সের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে বহুবার বিপদের মুখে পড়ে তাঁর ‘গোয়েন্দা’ জীবন। ১৮৩৭ সালে ভণ্ডামি ও ঘুষের দায়ে ফের জেলে যেতে হয় ইউজিনকে। সংস্থার সমস্ত ফাইল বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। যদিও এগারো মাসের মধ্যেই মুক্তি মেলে। যার মূল কারণ ছিল ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রতাপশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ। যাঁরা বিপদে-আপদে সাহায্য নিতেন ইউজিনের গোয়েন্দা সংস্থার থেকে। কারা ছিলেন সেই বিখ্যাত ব্যক্তি? বালজাক, ভিক্টর হিউগো, আলেকজান্ডার ডুমা কে নেই সেই তালিকায়!

আরও পড়ুন
বারোয়ারি গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী : রোমাঞ্চ পত্রিকার বিস্মৃত ইতিহাস

এরপর ইউজিন চলে আসেন লন্ডনে। অবশেষে ১৮৫৭ সালে মৃত্যু ঘটে তাঁর। ১৮২৯ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে ধরে রেখেছিলেন গোয়েন্দা জীবনের অসংখ্য কাহিনি। কিছুটা অতিরঞ্জিত আর মনগড়া কাহিনি থাকলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অস্বীকার করা মুশকিল। কারণ, এর সূত্র ধরেই ১৮৪১ সালে জন্ম হয় এক গোয়েন্দা চরিত্রের। যাঁকে অনেকেই মনে করেন, বিশ্বের প্রথম কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে। লেখকের নাম এডগার অ্যালান পো। উপন্যাসের নাম, ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’। আর চরিত্রটি হল আগস্ত দ্যুঁপে। 

Powered by Froala Editor