চেয়েছিলেন চাঁদের বুকে হাঁটতে। কিন্তু বাধ সেধেছিল শরীর। এক জটিল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থেমে গেছিল স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চাঁদে পৌঁছোন। না, ভুল হল। পৌঁছেছিল তাঁর অস্থি। পৃথিবীর একমাত্র মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। জীবনে না হোক, মৃত্যুতে পূরণ হল স্বপ্ন। তবে একা নন, সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন স্বয়ং শেক্সপিয়র।
গল্পের নায়কের নাম ইউজিন মেরলে সুমেকার (Eugene Merle Shoemaker)। জন্ম ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকায়। পেশায় ভূতত্ত্ববিদ। পৃথিবীর মাটিতে ছিটকে আসা উল্কা আর তাদের গহ্বর নিয়ে তীব্র আকর্ষণে জড়িয়ে পড়েন ‘নাসা’-র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ‘অ্যাপোলো মিশন’-এর প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে। চাঁদের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবেন নীল আর্মস্ট্রং-রা। চাই এমন একজন বিজ্ঞানীকে যিনি চাঁদের গহ্বরগুলি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন। সেই কাজের দায়িত্ব নিলেন সুমেকার।
তবে মন সন্তুষ্ট হচ্ছিল না এটুকুতে। প্রথম ভূতত্ত্ববিদ রূপে চাঁদে পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছাটা ক্রমশ আচ্ছন্ন করে তুলছিল। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। ‘অ্যাডিসন ডিজিজ’-এ আক্রান্ত তাঁর শরীর। অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থিগুলিতে পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি হয় না, ফলে জ্বর বা শরীরে জলের অভাবে প্রায়ই বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে হয়। এই শরীর নিয়ে তো এরকম বিপজ্জনক অভিযানে যাওয়া যায় না। অগত্যা মন দিলেন নীল আর্মস্ট্রংদের গড়ে তোলার কাজে। ১৯৬৯-এ চাঁদে পৌঁছোলেন তাঁরা।
তারপর কেটে গেছে প্রায় তিরিশটি বছর। একাধিক চন্দ্রাভিযানে অনেকেই পৌঁছেছেন চাঁদের দেশে। কিন্তু তাঁর ঠিকানা ল্যাবরেটরিতে। এর মধ্যে ১৯৯২ সালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী পেলেন এক আশ্চর্য ধূমকেতুর সন্ধান। তাঁদের নামেই পরিচিত হল সেটি—‘কোমেট সুমেকার-লেভি ৯’। ১৯৯৪-তে যা আছড়ে পড়ে বৃহস্পতির বুকে। আর একটা নেশা তাঁর রয়েই গেছে। পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনো মহাজাগতিক গহ্বরের সন্ধান পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান সেখানে।
আরও পড়ুন
চাঁদের মাটিতে শেষতম মানুষ জিন সারনান, লিখে আসেন মেয়ের নাম
আর সেটাই দেখা দিল মৃত্যুর কারণ হয়ে। ১৯৯৭-এ স্ত্রী ক্যারোলিনের সঙ্গে তিনি গাড়িতে অস্ট্রেলিয়ার পথ ধরে চলেছেন নতুন এক অভিযানে। হঠাতই দুর্ঘটনার মুখে পড়ে গাড়িটি। মৃত্যু ঘটে সুমেকারের। গুরুতর আহত হন স্ত্রী। চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল তাঁর।
আরও পড়ুন
চাঁদে মানুষের পা, নাকি স্টুডিয়োয় শুটিং? কুবরিকের দাবি ও অন্যান্য রহস্য
সেই সময়েই এক অদ্ভুত পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হন সহকর্মী ক্যারোলিন পর্কো। সুমেকারের আক্ষেপ তিনি জানতেন। চন্দ্রাভিযানে যাঁর গবেষণার অসীম গুরুত্ব, তাঁর একটা ইচ্ছা কি পূরণ সম্ভব নয়? ‘নাসা’-র অনুমতি নিয়ে তৈরি করলেন একটি নতুন ধরণের ক্যাপসুল। চাঁদের বুকেই সম্পন্ন হবে শেষকৃত্য।
১৯৯৭-এর ৩১ জুলাই চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল ‘লুনার প্রসপেক্টর’ (Lunar Prospetor)। ধাতব আবরণে মোড়া রইল সুমেকারের অস্থি। এর আগেও অবশ্য মহাকাশের বুকে অনেকেরই অস্থি ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাঁদে এই প্রথম। পরের বছরের ৬ জানুয়ারি চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে প্রসপেক্টর। চিরকালের জন্য সেখানেই রয়ে গেল সুমেকারের শরীরের অংশ। ক্যাপসুলের গায়ে লেখা জীবনবৃত্তান্ত। আর রইল শেক্সপিয়রের ‘রোমিও জুলিয়েট’ নাটকের কয়েকটি সংলাপ,
“And, when he shall die,
Take him and cut him out in little stars,
And he will make the face of heaven so fine
That all the world will be in love with night,
And pay no worship to the garish sun.”
তারার দেশে চিরশান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে তাঁর মরদেহ। স্বর্গের দিকে মুখখানি তোলা। দিন ফুরোলে, সারা পৃথিবী যখন রাত্রির প্রেমে মেতে থাকে, তখন সুমেকারের স্বপ্নটি যেন জীবন ফিরে পায় আবার।
Powered by Froala Editor