একটা বেশ বড়ো মাটির চাকতি, আর সেটাই অলংকার। না কানের মাকড়ি নয়, বরং এই অলংকার পরা হয় ঠোঁটের মধ্যে। অবাক হচ্ছেন? আসলে এমনটাই রীতি ইথিওপিয়ার বেশ কয়েকটা উপজাতির। এর মধ্যে মুরসি উপজাতির (Mursi Tribe) মধ্যেই এই রীতি সবচেয়ে বেশি। নিচের ঠোঁট কেটে সেখানে মাটির তৈরি এই চাকতি বসিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ধীরে ধীরে কাটা অংশটি যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই চাকতির আকারও বাড়িয়ে তোলা হয়। আর এই চাকতির (Lip Plates) আকারের উপরেই অনেক সময় মহিলাদের সামাজিক মর্যাদাও নির্ভর করে।
ইথিওপিয়ার উত্তরে তুরকানা হ্রদ এবং ওমো উপত্যকার মধ্যে বসবাস মুরসি, সুরি এবং মেকান উপজাতির মানুষদের। এর মধ্যে মুরসি ও সুরি উপজাতির মানুষদের মধ্যেই বিশেষত এই অলংকার দেখা যায়, যার নাম ‘ধেবি আ তুগোইন’ বা ইংরেজি তর্জমায় ‘লিপ-প্লেট’। সাধারণত বয়ঃসন্ধির পরেই এই অলংকার পরা হয়। মেয়েদের বয়স যখন ১৫-১৬ বছর হয়, তখন তাদের মা বা জনজাতির অন্য কোনো মহিলা প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রথমে নিচের ঠোঁট চিরে দেয়। মোটামুটি ৪ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটা গর্ত তৈরি করে সেখানে কাঠের ব্লক গুঁজে দেওয়া হয়। যতদিন ক্ষতস্থানের ঘা না শুকিয়ে যায়, ততদিন এই কাঠের টুকরোটি বের করা হয় না। ঘা শুকিয়ে গেলে সেই টুকরো বের করে নিয়ে কাঠ বা মাটির তৈরি অন্য চাকতি বসিয়ে দেওয়া হয়।
এইসব চাকতিও আবার নানা রকমের। কারোর চাকতি নিরেট, তার মধ্যেই নানা ধরনের নকশা আঁকা। কারোর চাকতির মধ্যে আবার রয়েছে নানা রকমের ছিদ্র। প্রত্যেকেই নিজেকে সাজিয়ে তুলতে চান নিজের মতো করে। সাধারণত ১২-১৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত চাকতিই দেখা যায় পরিণত বয়সের মহিলাদের ঠোঁটে। তবে কেউ কেউ আবার আরও বড়ো চাকতি পছন্দ করেন। মোটামুটি ২৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের চাকতিও দেখা যায় অনেক সময়ে। তবে মুরসি বা সুরি উপজাতির মহিলাদের প্রত্যেকের ঠোঁটেই যে এমন গয়না দেখা যায়, তা কিন্তু নয়।
আফ্রিকার উপজাতিগুলির মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান জানানোর রীতিও চিরকালীন। আর তাই কেউ কোনো প্রথার বিষয়েই কাউকে জোর করেন না। তবে কয়েক দশক আগে পর্যন্তও তাঁদের কাছে এটাই ছিল সৌন্দর্যের ধারনা। বর্তমানে সেই ধারনা খানিকটা বদলাচ্ছে। ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে উপজাতিগুলির মধ্যেও। ফলে অনেকেই আর এই ধরনের অলংকার পছন্দ করছেন না। এর জন্য কিন্তু কোনো ধরনের বৈষম্যের মুখে পড়তে হয় না মহিলাদের। এমনকি ইউরোপের বহু পর্যটকের বিশ্বাস ছিল, এই অলংকার নাকি মহিলাদের বিবাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। লিপ-প্লেটের আয়তনের উপর নাকি নির্ভর করে তাদের কন্যাপণের পরিমাণ। তবে নৃতাত্ত্বিক ডেভিড টার্টন গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এই দুয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহের সময় মহিলাদের ঠোঁটে প্লেট বসানো থাকে না। তাতে কন্যাপণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি কোনোদিনই। অন্যদিকে আরেকদল ইউরোপীয়ের মতে, মুরসি ও সুরি উপজাতির মানুষরা মহিলাদের দাসের মতো ব্যবহার করত। আর তারই চিহ্ন ছিল এই প্লেট। তবে এই মতেরও কোনো প্রমাণ মেলে না। কারণ ইউরোপীয়দের আগমনের আগে আফ্রিকার উপজাতিগুলির মধ্যে দাসপ্রথার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বরং আধুনিক মানুষও যেমন নিজেকে সুন্দর করে তুলতে নানারকম পিয়ার্সিং বা ট্যাটু করে থাকে, সেভাবেই এই ধরনের পিয়ার্সিং-এর প্রচলন দেখা যায় নানা উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে। শুধু তাঁদের এই সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে ইউরোপীয় দৃষ্টি অভ্যস্ত নয়, এটুকুই যা পার্থক্য।
আরও পড়ুন
২৫০ বছর পর উপজাতিদের হাতে ফিরছে অরণ্যের অধিকার
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
অরণ্যপূজার আড়ালে সংরক্ষণ, উপজাতি জীবনের কথা আন্তর্জাতিক জার্নালে