মাথায় কালো বেরেট টুপি, পরনে সাদা পাতলা জামা। এটাই ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক স্টাইল। এই শান্ত, স্নিগ্ধ রূপটির আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক বিপ্লবী মনোভাব। যা নিকারাগুয়ার সংগ্রামী মানুষগুলোর মনে ভরসা যুগিয়েছিল। একইসঙ্গে কার্দেনাল, কবি এবং বিপ্লবী এই মানুষটির যাত্রা থেমে গেল হঠাৎ। ৯৫ বছরে এসে হাসি মুছল নিকারাগুয়ার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব আর্নেস্টো কার্দেনালের।
আরও পড়ুন
হাসিই ছিল বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র, ১১২ বছর বয়সে থামলেন বিশ্বের প্রবীণতম পুরুষ
জন্মেছিলেন বিত্তশালী পরিবারে। গোটা জীবনটা সুখে, স্বাচ্ছন্দ্যে, বলা ভালো 'সোনার চামচ মুখে দিয়েই' কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা হয়নি। তিনি নিজেই সেটা করেননি। সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা তাঁর। সেই সঙ্গে মার্ক্সের প্রতি আকর্ষণও। কমিউনিজমকে বিশ্বাস করলেও, একইরকম ভরসা ছিল খ্রিস্টের প্রতিও। নিকারাগুয়ার ছেলেটি ১৯৬৫ সালে ধর্মযাজকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
আরও পড়ুন
প্রোজেক্টরে সিনেমা দেখতে চায় না কেউ, অভাবের সঙ্গে লড়ছেন কলকাতার বায়োস্কোপওয়ালা
অবশ্য এর আগেই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন আন্দোলনে। সময়টা পঞ্চাশের দশক। আনাস্তেশিও সোমোজা গার্সিয়া'র সরকারের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ায় চলছে বিক্ষোভ। সেখানে জড়িয়ে পড়লেন আর্নেস্টো। শুরু হল 'এপ্রিল আন্দোলন'। খ্রিস্ট ধর্মের যাজক ও পরে কার্ডিনাল হওয়ার পরও সেই প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালে নিকারাগুয়ার সোলেন্টিনাম দ্বীপে শিল্পী, কবি, চিত্রশিল্পীদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন বিশেষ সংগঠন। সবটাই সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। হয়ে উঠেছিলেন নিকারাগুয়া আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ।
আরও পড়ুন
দৃষ্টি হারিয়েছেন ১৯ বছরেই, আজ ভারতের প্রথম ব্লাইন্ড প্যারা-গ্লাইডার দিব্যাংশু
এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই উঠে এসেছিল কবিতা। যে কবিতা জীবনের কথা বলত, প্রেমের কথা বলত। কখনও সেটাই হয়ে উঠত লড়াইয়ের হাতিয়ার। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতে অন্যতম একটি নাম আর্নেস্টো কার্দেনাল। নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের তালিকাতেও ছিলেন তিনি। কিন্তু পাওয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর লেখা ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। পাঁচিল টপকে ছড়িয়ে পড়েছিল নানা দেশে। সেইসঙ্গে ছিল আন্দোলন। অবশেষে, ১৯৭৯ সালে আনাস্তেশিও সরকারের পতন হয়। নতুন সানডিনিস্টা সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন আর্নেস্টো। তাঁর ভাই, ফার্নান্দো কার্দেনাল দায়িত্ব পান শিক্ষায়।
আরও পড়ুন
কাট-কপি-পেস্টের জনক তিনি, আবিষ্কার করেছেন কারসারও; চলে গেলেন নীরবেই
১৯৮৬ সালেও, নিকারাগুয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন আর্নেস্টো-ই। তাঁর আমন্ত্রণেই সে-বছর কবীর সুমন(সুমন চট্টোপাধ্যায়) যান নিকারাগুয়ায়। অবশ্য তার আগেই নিকারাগুয়ার বিপ্লব নিয়ে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন সুমন। পিট সিগারের দৌলতেই তাঁর আলাপ হয় আর্নেস্টোর সঙ্গে। সুমন নিকারাগুয়ায় গিয়ে পরিচিত হন সে-দেশের বিপ্লব ও সঙ্গীতজগতের পটবদলের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
নেতাজি-পরিবারের সদস্যা থেকে সংসদীয় রাজনীতি – কৃষ্ণা বসু’র প্রয়াণে একটি অধ্যায়ের ইতি
প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আর্নেস্টোর কাজকর্ম সুনজরে ভালো চোখে দেখেনি ভ্যাটিকান সিটি। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন পোপ জন পল টু আর্নেস্টোকে রীতিমতো ভৎর্সনা করেন। সেই বছরই তাঁকে এবং তাঁর ভাই ফার্নান্দোকে ধর্মযাজকের পদ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। দীর্ঘ তিন দশক পর, ২০১৯ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাঁদের সাসপেনশন তুলে দেন। তিনি নিজেও বলতেন, "যীশু খ্রিস্টই আমাকে মার্ক্সের দিকে টেনেছেন।"
আরও পড়ুন
শুধুই পদার্থবিদ্যা নয়, বাংলার নদী-নালা নিয়েও দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন মেঘনাদ সাহা
মানুষের হয়ে লড়াইয়ে নামাটা তাঁর কাছে ছিল সেবার মতোই। সেই লড়াই এসে থামল ১ মার্চ। কালো বেরেটের টুপি চিরতরে খুলে রাখলেন আর্নেস্টো কার্দেনাল। ঘুমিয়ে গেলেন বরাবরের মতো…