আইন থেকেও ‘নেই’, ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামলেন পরিবেশকর্মীরা

শীতের আমেজ পড়তেই গোটা দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর কর্মসূচি। বাংলাতেও অন্যথা নেই তার। কালীপুজোর মরশুমে একদিকে যেমন বাজিজাত দূষণে ছেয়েছে গোটা রাজ্য, তেমনই বায়ুদূষণের মাত্রাকে ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে কৃষিজ অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর কর্মসূচি (Crop Stubble Burning)। কিন্তু বাজি জ্বালানো নিয়ে হাইকোর্ট রায় দিলেও, বৃহত্তর এই সমস্যাটি নিয়ে সেইভাবে হেলদোল নেই প্রশাসনের। এবার নাড়া পোড়ানো প্রতিরোধ দিবসে মানুষকে সচেতন করতে মাঠে নামলেন হাওড়ার পরিবেশকর্মীরা (Environment Workers)।

গতকাল উলুবেড়িয়ার চণ্ডীপুর পঞ্চায়েতের মহিষরেখা গ্রামে সচেতনামূলক প্রচার চালালেন মাধবপুর পরিবেশ চেতনা সমিতির পরিবেশকর্মীরা। কৃষকদের কাছে পৌঁছে নাড়া পোড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাবগুলি বোঝানো থেকে শুরু করে লিফলেট বিতরণ, এলাকা পরিদর্শন— সবরকম ভূমিকাতেই দেখা গেল তাঁদের। “মহিষরেখা বহু জায়গাতেই নাড়া পোড়ানো হচ্ছিল। কৃষকদের বোঝাতে, অনেকেই সেই মুহূর্তে তা বন্ধ রাখলেন। ভবিষ্যতে না করারও প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু সেটা কতটা সুদূরপ্রসারী হবে, বলা মুশকিল”, বলছিলেন মাধবপুর পরিবেশ চেতনা সমিতির কর্ণধার জয়িতা কুণ্ডু।

শুধু বায়ুদূষণই নয়, নাড়া পোড়ানোর জন্য পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চাষের জমিও। সরাসরি উত্তপ্ত হওয়ার ফলে, শক্ত হয়ে যায় মাটি। কমে জমির উর্বরতাও। মারা যায় বহু উপকারী অণু জীব এবং পতঙ্গ। ফলে, বছরের পর বছর নাড়া পোড়ানোর এই কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকরা নিজেদের বিপদও ডেকে আনছেন, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। জয়িতা কুণ্ডু জানালেন, “পর্যবেক্ষণে গিয়ে আমরা দেখেছি, কৃষকরাও সেটা স্বীকার করেছেন। এতে যে জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা ওঁরা জানেন।” কিন্তু তারপরেও কেন সব জেনেশুনে নাড়া পোড়ানোর পথকেই বেছে নেন কৃষকরা?

আরও পড়ুন
দূষণ কমাতে ‘গ্রিন ডেলিভারি’, উদ্যোগে বেঙ্গালুরুর পোস্ট অফিস


আরও পড়ুন
অপরিণত শিশুমৃত্যুতে শীর্ষে কলকাতা, ঘাতক কয়লাজনিত দূষণ

সহজ কথায় বলতে গেলে বিকল্পের অভাব। বিপুল পরিমাণ কৃষিজ বর্জ্যের গতি না হলে, পরবর্তী মরশুমে নতুন চারা বোনার সুযোগ থাকে না কৃষকদের কাছে। অবশ্য মালচার, রোটাভেটর, হ্যাপি সিডারের মতো যন্ত্রের মাধ্যমে ফসলের অবশিষ্টাংশকে ছোটো ছোটো টুকরো করে জমিতে মিশিয়ে দেওয়ার উপায় আছে। তাতে যেমন মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, তেমনই বাড়ে জলধারণ ক্ষমতাও। পাশাপাশি বেলার যন্ত্রের সাহায্যে, এই অবশিষ্টাংশ তুলে নিয়ে গিয়ে সার তৈরি বা অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ কৃষকরাই অবগত নন সংশ্লিষ্ট যন্ত্রগুলির সম্পর্কে। ফলে, কৃষি দপ্তরের সহযোগিতা পাওয়ার কথা থাকলেও, বেশিরভাগ কৃষকই আবেদন করেন না সেগুলির জন্য। পাশাপাশি আরও একটি বিকল্পের সন্ধান দিলেন জয়িতা, “কৃষি জমিতে ফসলের অবশিষ্টাংশ না পুড়িয়ে তা জ্বালানির কাজে ব্যবহার করলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় দূষণ।” 

আরও পড়ুন
রাস্তার মধ্যেই ধোঁয়া পরীক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণে পথে নামছে কলকাতা পুলিশ

নাড়া পোড়ানো-জাত এই দূষণের জন্য শুধুমাত্র কৃষকদের অজ্ঞানতাকেই দায়ী করা যায় না অবশ্য। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দপ্তর থেকে আইন করেই নিষিদ্ধ করা হয় ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো। কিন্তু দু’বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সেই মতো কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আজও। “খবরের কাগজে সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হলেও, প্রান্তিক অঞ্চলে গিয়ে বাস্তব অবস্থা পরিদর্শন করেন না কৃষি আধিকারিকরা”, অভিযোগ জানালেন জয়িতা। এক কথায় বলতে গেলে, রাজ্য সরকারের আইন থেকে গেছে খাতায়-কলমেই। শীতকালে এই বিশেষ সমস্যার জন্যই প্রতিবছর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে পড়ে দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব-সহ উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি। বাংলাও ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সেইদিকেই। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, দিল্লির পরিণতি থেকেও কি কোনো শিক্ষা নেবে না পশ্চিমবঙ্গ? উত্তর জানা নেই…

Powered by Froala Editor