১৯২৫ সাল। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ লিওনার্ডো উলে এবং তাঁর দলবল তখন ইরাকে। ধি-কার অঞ্চল, যা একসময়ে পরিচিত ছিল উর নামে, সেখানে চলছে খননের কাজ। তাঁরা সেখানে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী খুঁজে পেলেন, যাদের বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর। আশ্চর্যজনক নিঃসন্দেহে, কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। বরং, তাঁদের চমকে দিল অন্য একটি বিষয়। এই সামগ্রীগুলির শরীরে ছড়িয়ে আছে ইরাকের বিভিন্ন সময়ের শিল্পরীতির নমুনা। যেন কেউ যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছিল এদের। পাওয়া গেল সংগৃহিত বস্তুগুলির ‘ক্যাটালগ’-ও। তাহলে কি কোনো জাদুঘর (Museum) ছিল এখানে? তার সংগ্রাহক কে ছিল? রক্ষণাবেক্ষণই করত কে?
তাঁর নাম এন্নিগাল্ডি নান্না (Ennigaldi Nanna)। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সম্রাট নাবোনিডাসের (King Nabonidus) কন্যা। হ্যাঁ, পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘরের ‘কিউরেটর’ (Curator) ছিলেন এক মহিলা। লিওনার্ডোর আবিষ্কার অনুযায়ী, অধিকাংশ সামগ্রীর নিচেই অত্যন্ত যত্ন সহকারে লেখা থাকত সেগুলির বৈশিষ্ট্য। এখন অস্পষ্ট হয়ে গেলেও উদ্ধার করা গেছে সুমেরিয়ান ভাষায় লেখা লিপি। প্রতিটি বস্তুর নাম, মূল ভূখণ্ড, ইতিহাস সমস্ত কিছুই একসময়ে তালিকাবদ্ধ করা ছিল প্রাচীন ব্যাবিলনের (Babylon) এই ‘জাদুঘর’-এ। আর তার দায়িত্বে ছিলেন এন্নিগাল্ডি নান্না।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৬ থেকে ৫৩৯ পর্যন্ত ছিল নাবোনিডাসের রাজত্বকাল। প্রাচীন জিনিসের প্রতি শৌখিনতা ছিল তাঁরও। এমনকি, এই জাদুঘরের সামগ্রীর একটি বড়ো অংশ তাঁর দ্বারাই সংগৃহিত। শুরু করেছিলেন সেগুলিকে ক্রম অনুসারে তালিকাবদ্ধ করার কাজ। পরে যে দায়িত্ব এসে পড়ে এন্নিগাল্ডির উপরে। পিতার শখ ও আদর্শকেই তিনি সম্পূর্ণ রূপ দেন জাদুঘরে। তবে ব্যাবিলনের সভ্যতায় তাঁর দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি, স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। ৫৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্নিগাল্ডিকে অভিষিক্ত করা হয় প্রধান মহিলা পুরোহিতের পদে। যাকে সেই সময়ে বলা হত ‘এন্তু’। চন্দ্রদেব ‘সিন’-এর প্রতি নিবেদিত ছিল তাঁর সর্বস্ব। সাধারণত চন্দ্রদেব নাকি দৈববার্তার সাহায্যে নিজেই বেছে নিতেন ‘এন্তু’-কে। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম নেবুচাদনেজারের পর দীর্ঘদিন শূন্য ছিল এই পদ। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৪-তে আংশিক চন্দ্রগ্রহণকে রাজা নাবোনিডাস দেখেছিলেন রাজত্বের প্রতি শুভলক্ষণ হিসেবে। একই সঙ্গে ছিল এন্নিগাল্ডির ‘এন্তু’ হয়ে ওঠার সংকেত।
রাজার সুস্থতা ও রাজত্বের উন্নতির সমস্ত দৈবিক শক্তির আধার মনে করা হত ‘এন্তু’কে। মন্দিরের সম্পত্তির সম্পূর্ণ দায়িত্ব তো বটেই, পাশাপাশি মন্দিরের জমিজমার ‘মালিক’-ও তিনি। ধর্ম, জীবনযাপনের পাশাপাশি রাজকার্যেও প্রভাববিস্তার করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতে। এদিকে বাইরের শত্রুর আক্রমণে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে তাঁর দেশ। তার মধ্যেই জারি রইল জাদুঘরের কাজ। ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার কয়েকশো বছরের প্রাচীন সামগ্রী একত্রিত করে জিগুরাত মন্দিরের পাঁচশো ফুট দক্ষিণ-পূর্বে তিনি গড়ে তুললেন সংগ্রহশালা।
আরও পড়ুন
আজও যুদ্ধবিধ্বস্ত দিনগুলির সাক্ষ্য বহন করে হুন্দেরমানের ‘স্মৃতির জাদুঘর’
এন্নিগাল্ডি এবং তাঁর পিতা উভয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহের কিছু জিনিস থাকলেও মূল আকর্ষণগুলি ছিল বহু পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ থেকে তাঁদের সময়, এই ১৫০০ বছরের সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল জাদুঘরটি। এমনকি, একটি গবেষণাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল ‘ঐতিহাসিক’ সামগ্রীগুলিকে বিশ্লেষণ করার জন্য। বৈশিষ্ট্য, নাম, সময়কাল ধরে তিনটি আলাদা ভাষায় লেখা ছিল আলাদা ক্রমতালিকার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের ব্যবহৃত সামগ্রী, প্রাচীন উৎসবের মুখোশ, রাজা শুলগির (রাজত্বকাল ২০৯৪-২০৪৬ খ্রিঃ পূঃ) মূর্তি, প্রস্তরখণ্ডে লিখিত বহু লিপি—এন্নিগাল্ডির সংগ্রহশালা টক্কর দিতে পারে যে কোনো আধুনিক জাদুঘরকেও। ভেঙে যাওয়া বা বিপজ্জনক অবস্থায় থাকা সম্পদগুলির জন্য পৃথকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন
সমুদ্রের গভীরে জাদুঘর, যেতে হয় ডুবসাঁতারে
তারপর? কী হল সেই সংগ্রহশালার? এন্নিগাল্ডির পরবর্তী জীবন সম্পর্কে কিন্তু যথেষ্ট তথ্য নেই কারো হাতে। নাবোনিডাসের রাজত্বকাল শেষ হয়ে গেছে তার আগেই। ইউফ্রেটিস নদীর গতিপথ পরিবর্তন, খরা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব মিলিয়ে বিপদ নেমে আসে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। ক্রমে বন্ধ হয়ে যায় এন্নিগাল্ডির সংগ্রহশালা। ইতিহাসের কি আশ্চর্য লীলা! যিনি নিজে হাতে সংরক্ষণ করেছিলেন ইতিহাসকে, তালিকা করে রেখে দিয়েছিলেন সম্ভাব্য ভবিষ্যতের জন্য। তার গল্পই চাপা পড়ে রইল কয়েক হাজার বছর। মাত্র একশো বছর আগের আবিষ্কারে আবার যেন পুনর্জন্ম হল তাঁর। পৃথিবীর জন্য খুলে গেল প্রাচীনতম সংগ্রহশালার কাহিনি।
Powered by Froala Editor