ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের পূর্বপুরুষ ‘এনিয়াক’, ৭৫ বছরে পা বিশ্বের প্রথম কম্পিউটারের

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ছাড়া দৈনন্দিন জীবন প্রায় অচল। গত এক-দেড় দশকে দ্রুত ক্ষেত্র বাড়িয়েছে ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবহার। কিন্তু এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল প্রায় সাত দশক আগে। প্রথমবারের জন্য তৈরি হয়েছিল কম্পিউটার। তারপর ধীরে ধীরে বিবর্তনের পথে হেঁটে আয়তন কমেছে তার। গতকাল ৭৫তম ‘জন্মদিন’-এ পা দিল বিশ্বের সর্বপ্রথম কম্পিউটার ‘এনিয়াক’।

বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর পরই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিল এনিয়াক। দিনটা ছিল ১৯৪৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। ‘ইলেক্ট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর এন্ড কম্পিউটার’— এই ছিল তার পুরো নাম। মুর ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে প্রাথমিকভাবে স্থাপিত হয় এই কম্পিউটার। আজ যা পরিচিত পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে। 

জন প্রেস্পার একার্ট এবং জন উইলিয়ামের নকশাকৃত এই যন্ত্র তৈরিতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষ ডলার। আজকের দিনে যার মূল্য ৭২ লক্ষ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এবং অর্ডিনেন্স কর্পসের কাজেই ব্যবহৃত হত এই প্রাচীন কম্পিউটিং মেশিন। তবে আজকের মতো মাল্টিটাস্কিং ছিল না এনিয়াক। মূলত গাণিতিক সমস্যার গণনা করত এই যন্ত্র। 

তা সত্ত্বেও তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে বিপ্লব বললে বোধ হয় কম বলা হয়ে যায় এই যন্ত্রকে। কারণ, তার আগে পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনীর ব্যালাস্টিক এবং আর্টিলারি ট্র্যাজিকোলজির সমস্ত গণনাই করা হত খাতায় কলমে। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে একটানা কাজ করতেন হাজার হাজার মানুষ। এনিয়াকের ব্যবহার অনেকটাই যেন সহজ করে দিল গণনাকে। একজন ব্যক্তির ২০ ঘণ্টার শ্রমতুল্য গণনা মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে সমাধান করতে পারত এনিয়াক। কাজেই এই যন্ত্র প্রতিস্থাপিত করে প্রায় ২৪০০ গণনাকর্মীকে।

আরও পড়ুন
মুহূর্তেই গাণিতিক সমস্যার সমাধান, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল রাজস্থানের ‘হিউম্যান কম্পিউটার’

যদিও এরও প্রায় তিন বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিল কম্পইউটার বানানোর প্রস্তুতি। সামরিক গণনায় একাধিক ভুল থেকে যাওয়ার জন্য বিরক্ত হয়েই ১৯৪৩ সালে এমন যন্ত্র তৈরির জন্য দেশের বিজ্ঞানীদের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিল মার্কিন সরকার। জানতে পেরে অংশ নিয়েছিলেন জন প্রেস্পার এবং জন উইলিয়াম। ১৯৪৫ সালের শেষ দিকেই শেষ হয় এই কম্পিউটার তৈরির কাজ। ওই বছরই ১০ ডিসেম্বর প্রথম ব্যবহৃত হয় এনিয়াক। তবে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল তার অস্তিত্ব। মাটির নিচের ঘরে কেবলমাত্র কিছু গবেষকদের মাধ্যমেই পরিচালিত হত এই যন্ত্র।

তবে সমস্যা থেকে যায় অন্য একটি জায়গায়। এই কম্পিউটারে বিপুল পরিমাণ শক্তির চাহিদার জন্য মাঝে মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসত গোটা ফ্লোরিডা জুড়ে। মাত্র দু’মাস ব্যবহারের পরই তাই পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেওয়া হয়েছিল এই কম্পিউটারকে। আর তারপরই বিশ্বের সামনে এসেছিল এনিয়াক।

আরও পড়ুন
কম্পিউটার মাউসের সহ-স্রষ্টা তিনি, নীরবেই চলে গেলেন কিংবদন্তি ইঞ্জিনিয়ার বিল ইংলিশ

তিন ফুট উঁচু এই কম্পিউটারের দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ মিটার। ১৮০০ স্কোয়ার ফুট অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত এ যন্ত্রের ওজন প্রায় ২৭ টন। তবে এগিয়ে চলা প্রযুক্তি এবং সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এই কম্পিউটারেও বেশ কিছু বদল এনেছিলেন বিজ্ঞানীরা। স্টোরেজ-সহ বেশ কিছু যন্ত্রাংশের পরিবর্তন করতে দৈত্যাকার যন্ত্রকে নিয়ে যাওয়া হয়ছিল মেরিল্যান্ডে। তবে সেই বদলের পরেও খুব বেশিদিন দৌড়ে টিকে থাকতে পারেনি এনিয়াক। আরও দ্রুত কম্পিউটার যন্ত্র আবিষ্কারের পর ১৯৫৫ সালে বাতিল হয়ে যায় ঐতিহাসিক এই কম্পিউটার।

আজকে ব্যবহৃত সমস্ত ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটের পূর্বপুরুষ বলাই যায় এনিয়াককে। তার অস্তিত্ব না থাকলে হয়তো আজকের দিনে এসে পৌঁছাতে আরও কয়েক দশক সময় লেগে যেত বিজ্ঞানের, মানব সভ্যতার। তবে বিশ্বের সর্বপ্রথম কম্পিউটার এবং তার দুই সৃষ্টিকর্তার নাম বার বার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলেও, বিস্মৃতির অতলে থেকে গেছে ছয় মহিলা প্রোগ্রামারের নাম। জিন জেনিঙ্কস বারটিক, মার্লিন ওয়েসকফ মেল্টজার, স্নাইডার হোলবার্টন, রুথ লিচারম্যান, ক্যাথলিন ম্যাকেন্ট্রি এবং ফ্রেঞ্চেস বিলাস স্পেন্স। এই ছয় প্রযুক্তিবিদ না থাকলে হয়তো কোনোদিন এনিয়াককে ব্যবহার করাই সম্ভব হয়ে উঠত না। সফটওয়্যারের ব্যবহার থেকে ডেটা ইনপুট— সমস্তটার পিছনেই ছিলেন এই ছয় গবেষক। অথচ এমন একটি বিস্ময়ের কারিগর হয়েও অনালোচিত তাঁরা। ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে দেওয়া হয়েছে তাঁদের অস্তিত্ব। বিজ্ঞানের সাফল্যের সঙ্গে এনিয়াকের ৭৬তম জন্মদিন স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজের সেই লিঙ্গ বৈষম্যের কথাও…

আরও পড়ুন
১০ হাজার বছরের কাজ ৩ মিনিটে, গুগল নিয়ে এল কোয়ান্টাম কম্পিউটার

Powered by Froala Editor

More From Author See More