স্বাধীনতার আগেই বাংলায় গড়ে উঠেছিল যে-সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

/১০

তাত্ত্বিক বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে বাঙালিদের অবদান অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জগতেও বাঙালি পিছিয়ে নেই। ফজলুর রহমান খান, অমর বসু বা বীরেন মুখার্জির মতোই মনে করতে হয় উনিশ শতকের নীলমণি মিত্রর কথাও। কিন্তু বাংলার বুকে প্রথাগত ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার (Engineering Education) শুরু কীভাবে? জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে সেই উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। ব্রিটিশ সরকারের হাত দিয়েই যার শুরু। এরপর স্বাধীনতার আগে (Before Independence) পর্যন্ত একের পর এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তৈরি হয়েছে বাংলার বুকে।

/১০

উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় বেশ কিছু কারখানা তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেইসব কারখানা পরিচালনার জন্য ইংল্যান্ড থেকে ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটা বেশ সমস্যার। আর তাই ১৮৫৬ সালে রাইটার্স বিল্ডিং-এর মধ্যেই জন্ম নিল বাংলার প্রথম কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ক্যালকাটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’। পরের বছরেই তৈরি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকেও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা হল। ১৮৬৫ সালে ক্যালকাটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মিলেমিশে গেল প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে।

/১০

১৮৮০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের থেকে আবার আলাদা হয়ে যায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। হাওড়ার শিবপুরে তৈরি হল নতুন ক্যাম্পাস। নতুন নাম, গভর্নমেন্ট কলেজ, হাওড়া। এরপর একাধিকবার নাম বদলেছে এই প্রতিষ্ঠানের। ১৯২০ সালে নাম বদলে রাখা হয় গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবপুর। স্বাধীনতার পর আবার নাম বদলে হয় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (বেসু)। বর্তমানে তার নাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। আজ শিবপুরের আইআইইএসটি একটি জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

/১০

ক্যালকাটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান গবেষণার কাজ চলতেই থাকে। কিন্তু সেই তুলনায় যথেষ্ট পিছিয়ে পড়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন কলেজের পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা হিসাবেই রাখতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু বাঙালিরা সেই পরিকল্পনা মেনে নেননি কোনোদিন। আর এভাবেই ১৯১৪ সালে পথচলা শুরু হল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের।

/১০

১৯১২ সালে ব্যারিস্টার স্যার তারকনাথ পালিত একটি চিঠি পাঠালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাতে লেখা, তিনি সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা এবং রাজাবাজার অঞ্চলের একটি বাড়ি দান করলেন বিশ্ববিদ্যালয়কে। এর সঙ্গেই আরও ১০ লক্ষ টাকা যোগ করলেন স্যার রাসবিহারী ঘোষ। এভাবেই শুরু হল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পথচলা। সায়েন্স কলেজ হলেও তার মূল ভূমিকা ছিল প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান, বিশেষত ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষণার কাজেই। এখনও একাধিক বিষয়ে বিটেক এবং এমটেক স্তরের পড়াশোনা হয় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে।

/১০

তারকনাথ পালিত এবং রাসবিহারী ঘোষের হাতে তৈরি হলেও রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ। তবে তার আগেই বাংলার বুকে গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ স্বদেশি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ১৯০৫ সালে, একেবারে স্বদেশি আন্দোলনের গোড়াতেই গড়ে ওঠে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন। রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী বা স্যার রাসবিহারী ঘোষের পাশাপাশি এই উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বও। ১৯১০ সালে এই সংস্থার অধীনেই গড়ে ওঠে কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, বেঙ্গল।

/১০

কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির সঙ্গে নানা সময়ে যুক্ত থেকেছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো মানুষরাও। স্বাধীনতার পর ১৯৫৫ সালে তারই নাম বদলে হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাশাপাশি গড়ে ওঠে একটি স্বতন্ত্র পলিটেকনিক কলেজও। আজ বাংলার গর্ব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যে কোনো জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

/১০

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলার বুকে উন্নত চর্মদ্রব্য তৈরির উদ্যোগ নিতে থাকে ব্রিটিশ সরকার। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯২১ সালে তৈরি হয় ক্যালকাটা রিসার্চ ট্যানারি। ১৯২৬ সালে তারই নাম বদলে হয় বেঙ্গল ট্যানিং ইনস্টিটিউট। স্বাধীনতার পর সেই প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে তৈরি হয় গভর্নমেন্ট কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লেদার টেকনোলজি।

/১০

১৯৪১ সালে বেলেঘাটা অঞ্চলে তৈরি হয় গভর্নমেন্ট কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সেরামিক টেকনোলজি। আজও রাজ্যের প্রথম সারির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তালিকায় রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।

১০/১০

স্বাধীন ভারতের কেন্দ্র সরকারও বাংলায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার বিকাশে এগিয়ে এসেছে। দেশের প্রথম আইআইটি তৈরি হয় ১৯৫১ সালে খড়গপুরে। ১৯৬০ সালে দুর্গাপুরে তৈরি হয় রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। যা আজকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি তকমাপ্রাপ্ত। পরবর্তীকালে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে একের পর এক জেলায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে গড়ে উঠেছে পলিটেকনিক কলেজও। ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় দেশের অনেক রাজ্যের চেয়েই আজও এগিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

Powered by Froala Editor