স্কুলে পড়াশোনা আঞ্চলিক ভাষাতেই। তবে উচ্চমাধ্যমিকের পর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে গেলে বাধ্যতামূলকভাবেই ইংরাজিতে পড়াশোনা করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। সেক্ষেত্রে অনেকেই সমস্যার সম্মুখীন হয় সম্পূর্ণ ইংরাজি পঠনপাঠনে। সেই সমস্যা সমাধানেই প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা-সহ বিভিন্ন অঞ্চলিক ভাষায় পঠনপাঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনোলজিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই)। এবার সেই সিদ্ধান্তের রেশ ধরেই শুরু হল পলিটেকনিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষের বই আঞ্চলিক ভাষায় মুদ্রণের কাজ। বাংলায় এই দায়িত্বের ভারই পড়ল ম্যাকাউট অর্থাৎ রাজ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর।
তবে প্রযুক্তিবিদ্যায় আঞ্চলিক ভাষায় পঠনপাঠনের জন্য কেবলমাত্র প্রথম বর্ষের কথাই এখনও পর্যন্ত চিন্তাভাবনা করেছে ম্যাকাউট। দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বর্ষে এই মুহূর্তে শুরু হচ্ছে না ইংরাজি থেকে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থার স্থানান্তরীকরণ প্রক্রিয়া। অন্যদিকে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে স্থানীয় ভাষায় প্রথম বর্ষের পাঠ্য পুস্তক তৈরির কার্যক্রম। এআইসিটিই-র অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং প্রাক্তন অধ্যাপকদের কাছে পৌঁছেছে প্রযুক্তিবিদ্যার নিয়ামক সংস্থার তরফে ই-মেল। তাঁদের অনুরোধ করা হয়েছে আঞ্চলিক ভাষায় বই অনুবাদের জন্য।
তবে এআইসিটিই-র এই সিদ্ধান্ত ঘিরেই উঠে আসছে বেশ কিছু তর্ক-বিতর্কের প্রসঙ্গও। যে বিতর্ক আসলে চলে আসছে কয়েক দশক ধরে। আঞ্চলিক ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পরিধি যে বেশ খানিকটা সীমিত হয়ে যায় সে প্রসঙ্গেই ম্যাকাউটের এক অধ্যাপক জানান, “প্রযুক্তি কিংবা চিকিৎসার ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্র জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরের। এবং বৃহত্তর পরিসরে সেখানে ইংরাজিকেই ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে অঞ্চলিক ভাষা থেকে ইংরাজিতে বিজ্ঞানের পরিভাষার বদল প্রভাব ফেলবে ছাত্রদের কর্মক্ষেত্রে। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অঞ্চলিক ভাষা বলতে আমাদের রাজ্যে বাংলাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে ছাত্রটির মাতৃভাষা সাঁওতালি কিংবা বাংলার অন্য কোনো উপভাষা, তাঁর ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কতটা সমস্যা সমাধান করবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।”
অন্যদিকে ম্যাকাউটের প্রাক্তন ছাত্র অর্ণব বসু এই প্রসঙ্গে বললেন, “আঞ্চলিক ভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে চাওয়ার অর্থ অঞ্চলিক ভাষাকে প্রমোট করতে চাওয়া। কিন্তু এই উদ্যোগ আরও তার থেকেও আগে নেওয়া দরকার বেসিক এডুকেশনাল সিস্টেমে। সেখানে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির পরিকাঠামো ভেঙে পড়া। ফলে পশ্চিমবঙ্গে যদি বাংলা মিডিয়াম ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাটাই কমে যায় তবে পরবর্তীক্ষেত্রে গিয়ে তারা বাংলাটাকে বেছে নেবে না পড়াশোনার মাধ্যম হিসাবে। এবং গোটা বাংলার মোট ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খুবই অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করতে যান। যদি বাংলা বা আঞ্চলিক ভাষাকে প্রোমোট করতেই হয় তবে শিক্ষার পুরো পরিকাঠামোরই বদল করা প্রয়োজন। সেখানে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে প্রথম ভাষা হিসাবে মাতৃভাষা বাধ্যতামূলক হলে অনেক বেশি এই উদ্দেশ্য কার্যকরী হবে বলেই আমার মনে হয়।”
আরও পড়ুন
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেল তেলেগু, বড়োদিনের বড়ো উপহার
একদিকে ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার কথা ভেবে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত তবে কি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে? থেকে যাচ্ছে সেই প্রশ্নই। শুধু বাংলাতেই নয়; তামিল, তেলেগু, গুজরাটি, ওড়িশি-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতেই শুরু হয়ে গেছে এই অনুবাদের কর্মসূচি। ভাষাবদল হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মোট ৮টি এবং পলিটেকনিকের ১০টি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের। পাশাপাশি এও জানানো হয়েছে, প্রতিটি বইয়ের ক্ষেত্রে যে আঞ্চলিক ভাষার অনুবাদ সবথেকে সহজতর হবে, পরবর্তীকালে তাকেই অনুকরণ করে বানানো হবে অন্যান্য ভাষায় প্রকাশিত বইগুলি...
আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাত ধরেই আদালতে ঢুকেছিল বাংলা ভাষা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সংস্কৃত ভাষায় শপথগ্রহণ, নিউজিল্যান্ডের সংসদে ইতিহাস তৈরি ভারতীয় বংশোদ্ভূতের