ঠিক যেন ‘স্বদেশ’ সিনেমা; খেলনার মাধ্যমেই গ্রামে-গ্রামে বিজ্ঞানের পাঠ দিচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার

সত্তর দশক। গোটা ভারত তখন ফুটছে। নকশাল আন্দোলনের আগুন জ্বলছে দিকে দিকে। কয়েক বছর পরেই নেমে আসবে জরুরি অবস্থার খাঁড়া। তার মধ্যেই আইআইটি কানপুরে বেড়ে উঠছেন এক তরুণ। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এরপর নামী বেসরকারি সংস্থায় চাকরি, ধীরে ধীরে বেতন বৃদ্ধি, প্রোজেক্ট— এরই চক্রব্যূহে চলবে জীবন। তেমনটাই যে নিয়ম! 

কিন্তু সেই তরুণ, অরবিন্দ গুপ্তার বেলায় সেটা ঠিক খাটল না। আইআইটি কানপুরের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই চাকরির ডাক আসে। অরবিন্দবাবুও সেখানে জুড়ে যান। টেলকো’র মতো প্রতিষ্ঠানে শুরু করেন চাকরির জীবন। কিন্তু মন বসছে না সেখানে। বারবার মনে হচ্ছে, এই জায়গাটা তাঁর নয়। গণ্ডি ছিঁড়ে বেরোতে পারছেন না। কিন্তু সাহস যে সঞ্চয় করতেই হবে। একসময় পারলেন অরবিন্দ গুপ্তা। ১৯৭৮ সাল। টেলকো-র চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি। এরপরই শুরু হল এক অদ্ভুত অধ্যায়। বিজ্ঞানের সঙ্গে মিশে গেল লোকচর্চা; মিশে গেল খেলনা। অরবিন্দের হাত ধরে শুরু হল বিজ্ঞানচর্চার নতুন যাত্রা… 

বাংলা তো বটেই, আবহমান কাল ধরে গোটা ভারতের সমাজজীবনে পুতুল এবং খেলনার প্রভাব রয়েছে। ছোটোবেলায় এসবের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে একটা বড়ো অংশের শিশুরা। সময় বদলেছে, আমরাও আধুনিক হয়েছি। খেলনার রূপ বদলালেও একেবারে ছেড়ে যায়নি শৈশবকে। আর এই রাস্তাকেই আঁকড়ে ধরলেন অরবিন্দ গুপ্তা। কেমন হয়, এই খেলনার হাত ধরেই যদি বিজ্ঞান আরও সহজভাবে পৌঁছে যায় সবার মধ্যে? শুরু হল নতুন এক কর্মকাণ্ড। আজ ৩০ বছর ধরে অরবিন্দ পৌঁছে যাচ্ছেন ভারতের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। উদ্দেশ্য একটাই, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা যাতে আরও সহজভাবে, হাতে-কলমে বিজ্ঞানকে বুঝতে পারে। আর সেই কাজেরই প্রধান অস্ত্র হল— খেলনা এবং পুতুল! 

লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল সত্তরের দশকের কথা। কেবল ভারত নয়; ফ্রান্স, আমেরিকা, ভিয়েতনাম সব জায়গাই উত্তাল। আর ভারতের দিকে দিকে নতুন একটা কথা ছড়িয়ে পড়ছিল। ‘আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ো, তাঁদের সঙ্গে মেশো, তাঁদের প্রয়োজন বোঝো; আর তাঁদের রোজকারের সামগ্রী দিয়েই নতুন নতুন জিনিস তৈরি করো।’ এই মন্ত্রই অরবিন্দ গুপ্তার জীবনের পাথেয় হয়ে রইল। আইআইটি’র জীবনে আরও একজনের কাজ তাঁর সামনে উঠে এল। তিনি অনিল সদগোপাল। ক্যালটেক থেকে পিএইচডি করা এই গবেষক প্রথমে গবেষণার কাজেই মন দিয়েছিলেন। টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে কাজও করছিলেন। একটা পর্যায়ের পর তাঁর মনে হল, এতে আখেরে কিছুই হচ্ছে না। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞান পৌঁছচ্ছে না। একসময় ছেড়ে দিলেন সবকিছু। চলে গেলেন গ্রামের মানুষদের কাছে। ঘুরে ঘুরে সহজভাবে বিজ্ঞানশিক্ষার কাজ শুরু করলেন তিনি… 

ঠিক যেন ‘স্বদেশ’ সিনেমার মোহন ভার্গব! তবে এঁরা রিলে নন, বাস্তবের মাটিতে বিচরণ করছেন। অনিল সদগোপালের কাজটিই প্রেরণা যোগাল অরবিন্দ গুপ্তাকে। টেলকো-র চাকরি ছেড়ে বেছে নিলেন বিজ্ঞানশিক্ষার কাজ। হোশাঙ্গাবাদ সায়েন্স টিচিং প্রোগ্রামে যুক্ত হয়ে বুঝলেন, গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে সহজভাবে বিজ্ঞানকে যদি পৌঁছে দিতে হয়, তাহলে তাদের মতো করে ভাবতে হবে। তাদের সরঞ্জাম দিয়েই সেই কাজ করা যাবে। অরবিন্দ বেছে নিলেন যাবতীয় ফেলে দেওয়া বর্জ্য সামগ্রীকে। ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল, কাগজ, বাক্স, রাবার ইত্যাদি বহু সামগ্রী দিয়ে তৈরি করলেন খেলনা। আদতে সব খেলারই জিনিস; কিন্তু তার ভেতর দিয়েই বিজ্ঞানের গোলকধাঁধায় পৌঁছে গেল সবাই। আরও একটি সামগ্রী ছিল— দেশলাই কাঠি। এই সমস্ত জিনিস দিয়েই বিজ্ঞানের প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিকে এই ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে দিলেন অরবিন্দ।

শুধু খেলনাই নয়, সেগুলো দিয়ে অরবিন্দ দেখালেন বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট। ধীরে ধীরে তাঁকে ঘিরে তৈরি হল একটি বড়ো বৃত্ত। ছোটো ছোটো খেলনা তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চলল বিজ্ঞানশিক্ষার কাজ। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩০০০টি স্কুলে নিজের কাজ নিয়ে পৌঁছে গেছেন অরবিন্দ গুপ্তা। সংখ্যাটি থেমে নেই, আরও বাড়ছে। ক্লাসরুমের একঘেয়ে পড়াশোনা নয়; বরং মজা করতে করতে শিখে নেওয়া জটিল জিনিস— এটাই তো আসল। এর বাইরে গিয়ে অনেকগুলো বইও লিখেছেন অরবিন্দবাবু। ১৯৮৭ সালে প্রকাশ পাওয়া ‘ম্যাচস্টিক মডেলস অ্যান্ড আদার সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট’ বইটি এখনও পর্যন্ত ১৩টি ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আরও বহু বই। সবকিছুরই মূল ভিত্তি বিজ্ঞান এবং খেলনা। 

নিজের কাজের জন্য পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ২০১৮ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকে পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। এছাড়াও দশ বিদেশের আরও অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি। অরবিন্দ গুপ্তা এখনও থামেননি। এখনও কাজ করে চলেছেন নিজের ছোটো ছোটো খেলনা আর বিজ্ঞান নিয়ে। তিরিশ বছর ধরে চলছে এই কর্মযজ্ঞ। যখন চাকরি ছেড়েছিলেন, তখন ভয় পাননি? উত্তরে অরবিন্দ গুপ্তা শোনান তাঁর মায়ের কাহিনি। চাকরি ছাড়ার পর তিনিই অরবিন্দকে বলেছিলেন, ‘যা করেছো ভালো করেছো। এবার সত্যিকারের কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হও’। সারাজীবন এই সত্যির কাছেই ফিরে ফিরে যান অরবিন্দবাবু। সেটাই যে লক্ষ্য… 

তথ্যসূত্র- 

১) ‘Arvind Gupta: Turning Trash into toys for learning’, Ted Talk

২) ‘Meet The Man Who Has Been Teaching Science Using Toys Made From Trash For Over 30 Years’, The Logical Indian

৩) ‘Unorthodox Career Choices – in conversation with Arvind Gupta’, Vox IIT Kanpur            

Powered by Froala Editor

More From Author See More