সময়টা ১৯১৬ সাল। ইউরোপের বুকে তখন ঘটে চলেছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এমন বিরাট যুদ্ধ তার আগে দেখেননি কেউই। অসংখ্য যুবক প্রাণ সংশয় নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন তাঁদের সেনাবাহিনীর হয়ে। তাঁদের অসীম সাহসিকতার সাক্ষী থাকছে গোটা পৃথিবী। তবে সামগ্রিক চেহারাটা এমন কর্মচঞ্চল মনে করলে একটু ভুল হবে। একই সময় ঘটছে আরও এক অভূতপূর্ব ঘটনা। একটি রোগের সংক্রমণ। যে সংক্রমণ প্রায় মহামারীর আকার নিতে চলেছিল। আর এই রোগের ফলেই ক্রমশ আলস্যের মধ্যে চলে যাচ্ছিলেন অসংখ্য মানুষ। সারা জীবন কেটে যাচ্ছিল শুধুই ঘুমের মধ্যে।
১৯১৬ সালে ভের্ডনের যুদ্ধ ফেরত এক সৈনিকের শরীরে প্রথম এই রোগটির প্রভাব দেখা যায়। সেনাবাহিনীতে কাজ করার কারণেই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শরীরের দক্ষতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু হঠাৎ এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায় তাঁর ব্যবহারে। কোনো কাজেই যেন আর মন বসছে না। স্থির চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকছেন, অথচ যেন দেখছেন না কিছুই। আর সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে পড়ছেন তিনি। তখন অনেক চেষ্টা করেও আর সেই ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না। এমন ঘটনায় তাঁর পরিবারের লোকজন তো বটেই, চিকিৎসকরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। আর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায়, তিনি একা নন। একই ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন আরো অনেক সৈনিক। তাঁদের সংখ্যাটা দেখতে দেখতে বেড়েই চলে।
শুধুই ইউরোপ নয়, কিছুদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কেও এক ব্যক্তির শরীরে ফুটে উঠল অনুরূপ উপসর্গ। চোখের সামনে মারা যেতে লাগলেন সবাই। আর মৃত্যুর কারণ প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই শ্বাসযন্ত্রের পক্ষাঘাত। রোগের উৎস খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন চিকিৎসকরা। অবশেষে ভিয়েনার এক স্নায়ুবিদ, ভন ইকোনমো লক্ষ করলেন এই রোগের প্রকোপ যাঁদের উপর এসে পড়ছে, তাঁদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। আর এর ফলেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে তাঁদের শরীরে। সেই ঘুম যে কখন চিরনিদ্রায় পরিণত হচ্ছে, সেকথা টের পাওয়াও যাচ্ছে না।
ভনের গবেষণার জন্যই এই রোগ 'ভন ইকোনমো'জ এনসেফেলাইটিস' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আর ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগের নাম, 'এনসেফেলাইটিস ল্যাথার্জিকা'। তবে এর পরেও রোগের প্রকোপ আটকানো যায়নি। মানুষের শরীর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল বহু কুকুরের শরীরেও। আর ভাইরাস সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণাই তখনও তৈরি হয়নি। প্রায় ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ চলেছিল। তারপর দেখা যায়, অ্যান্টি-ভাইরাস ওষুধের সাহায্যেই এই রোগ সারিয়ে তোলা যাচ্ছে। তবে এমন বিস্ময়কর অসুখ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই এসেছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে যে কত মানুষের প্রাণ নিয়েছে এই রোগ, তার কোনো সঠিক হিসাব বোধহয় নেই।
Powered by Froala Editor