বাবার পদাঙ্ক মেনেই মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখতে চেয়েছিলেন শাঁওলি

“বাঁচা মানে ছুঁতে পারা–!
বাঁচা মানে চোখ ভ’রে দেখা–!
প্রাণ ভ’রে শোনা–!”

লিখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, হৃৎপিণ্ডের শব্দটুকু শুধু বেঁচে থাকা নয়। আজ সেই শিল্পীর হৃৎপিণ্ডের শব্দটুকু থেমে গেল। তারই সঙ্গে কি হারিয়ে গেল তাঁর দেখাগুলো, শোনাগুলোও? সে-কথার উত্তর দিতে এখন আর উপস্থিত নেই শাঁওলি মিত্র (Shaoli Mitra)। তবে তাঁর সৃষ্টিগুলো থেকে যাবে। বাংলা নাটকের অস্তিত্ব যতদিন মঞ্চে থাকবে, শাঁওলি মিত্র ততদিন থেকে যাবেন সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে। নাটক আর জীবনকে যে কোনোদিন আলাদা করে দেখেননি তিনি।

বেশ কয়েকমাস ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালেও। সেখানেই আজ দুপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শাঁওলি মিত্র। অবশ্য তাঁর অসুস্থতার সময় থেকেই সমস্ত খবর গোপন করে রাখা হয়েছিল। পিতা শম্ভু মিত্রের দেখানো পথেই যেন হাঁটলেন তাঁর কন্যা। শম্ভু মিত্রও বলেছিলেন, তাঁর দেহ সৎকারের আগে যেন মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করা না হয়। শাঁওলির শেষ ইচ্ছাও ছিল তাই। আর সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েও পরিবারের সদস্যরা মরদেহ সৎকারের পরেই মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছেন।

বাংলার সংস্কৃতি জগতে শাঁওলি মিত্রের পরিচয় দেওয়াটা বেশ কঠিন। তিনি কবি, প্রাবন্ধিক, সমালোচক। তবে এই সমস্ত সত্তাকে ছাপিয়ে তিনি একজন অভিনেতা। নাটকের মঞ্চই তাঁর প্রধান ঠিকানা। বাংলা নাটকে কোনো স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দেননি তিনি। তবে শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের হাত ধরে যে সৎনাট্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাকে ধারণ এবং লালন করেছেন তিনি। ‘পঞ্চম বৈদিক’ নাট্যদলের মধ্যে দিয়ে সেই ধারাকে বহমান রেখেছিলেন এই একুশ শতকের দুই দশক জুড়েও। যার শুরুটা হয়েছিল শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ‘পুতুলখেলা’ নাটকটি দিয়ে। হেনরিক ইবসেনের কাহিনি অবলম্বনে লিখিত এই নাটকটিতে নোরার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শাঁওলি। আর তারপর কখনও বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকে একক অভিনেতা হয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন মহাভারতের নানা চরিত্র। আবার এই নাটকের রচয়িতাও তিনি। নাটকের সঙ্গে সময়ের মেলবন্ধনই ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একই নাটকের সংলাপ বদলে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে উপস্থাপনার ভঙ্গিও। ‘কথা অমৃতসমান’ তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। ১৯৯০ সালে লেখা এই নাটকই ’৯২ সালের পর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে নতুন চেহারায় হাজির হয়। নাটকের ভিতর দিয়েই কখনও তুলে ধরেছেন লিঙ্গবৈষম্যের বাস্তবতা। কখনও আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর চেহারা। বাদল সরকারের লেখা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটককে তুলে এনেছেন বিশ শতকের বিধ্বস্ত পৃথিবীর চেহারা দেখাতে। আবার ‘বিতত বিতংস’ নাটকে তুলে ধরেছেন পরিবেশ সমস্যার কথাও। নাটক তাঁর কাছে ছিল প্রতিবাদের মাধ্যম। যে প্রতিবাদকে তিনি ধরে রেখেছিলেন নিজের জীবনের মধ্যে।

শাঁওলি মিত্র আর কোনোদিন মঞ্চে উঠবেন না। কিন্তু বাংলা নাটকের জগৎ তাঁর উত্তরাধিকার ধরে রাখবে, এটুকু আশা করাই যায়।

Powered by Froala Editor