সুযোগ ছিল বিলেতভ্রমণের। মোটা মাইনের চাকরিও একপ্রকার পাকাই ছিল তাঁর জন্য। কিন্তু এসব জলাঞ্জলি দিয়ে শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নিচে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। পাথেয় করে নিয়েছিলেন নিজের জীবনের। হয়ে উঠেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয়পাত্র। গোরা সর্বাধিকারী (Gora Sarbadhikari)। রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব তিনি। না, তাঁকে নিয়ে চর্চা নেই সেভাবে। আজ প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়েও ইন্টারনেটে তাঁর গান খোঁজাও এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। তা সত্ত্বেও তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিহাস।
দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পী (Singer)। গতকাল না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন তিনি। তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্টে গেল রবীন্দ্রগানের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের পাতাও। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
জীবনের একটা বড়ো অংশ শান্তিনিকেতনে কাটালেও তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঝাড়গ্রামে। কাজের সূত্রেই কলকাতা ছেড়ে ঝাড়গ্রামে বাড়ি করেছিলেন তাঁর দাদু। ছেলেবেলা কেটেছে সেখানেই। পরবর্তীতে কলকাতায় এসে ভর্তি হওয়া বেলুড় বিদ্যামন্দিরে। সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া শুরু হয়েছিল ঝাড়গ্রামেই। কলকাতায় এসে যেন আরও এক প্রশস্ত আকাশ খুঁজে পেলেন তিনি। মাসির সূত্রেই তাঁর পরিচয় হল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে। সাক্ষাৎ দেবদর্শন যাকে বলে। ধনঞ্জয়বাবুকে গান শেখানোর অনুরোধ করেছিলেন গোরা। না, খালি হাতে ফেরাননি তিনি।
তারপর থেকে অধিকাংশ দিনই কলেজের শেষ পিরিয়ডে হদিশ মিলত না তাঁর। ক্লাস না করে তিনি হাজিরা দিতেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের 'বাড়ি', সিসিল হোটেলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত ছাত্র-শিক্ষকের দ্বৈরথ। তাঁর কাছেই শ্যামাসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন গোরা সর্বাধিকারী। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত? বলতে গেলে খানিকটা আকস্মিকভাবে দিক পরিবর্তন করে ঢুকে পড়া রবীন্দ্রগানের জগতে।
আরও পড়ুন
হেমন্তকণ্ঠে লোকগান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি সংস্করণ, ‘দুর্লভ’ সংকলন যুবকের
সেটা ১৯৬১ সাল। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ট্রেনিং-এর সমস্ত বন্দোবস্তই পাকা হয়ে গেছে জার্মানিতে। কাটা হয়ে গেছে বিমানের টিকিটও। দেশ ছাড়ার আগে দিন কয়েকের ছুটি কাটাতে বোলপুরে হাজির হয়েছিলেন বর্ষীয়ান শিল্পী। আর তারপরই এক অন্যদিকে বাঁক নেয় তাঁর জীবন। শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধতা, পরিবেশ, সঙ্গীতভবনের ডাক এড়ানোর সাধ্য কারই বা আছে? গান, সেতার, নাচ— সুরের ঘনঘটা সেখানে। সে যেন এক স্বর্গরাজ্য। এক লহমাতেই গন্তব্য বদলে ফেলেন গোরা। অনুনয়-বিনয়ের পর সুযোগ আসে পরীক্ষা দেওয়ার। বলার অপেক্ষা থাকে না সফলভাবেই সেই বাধা উত্তীর্ণ হন তিনি। বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও বিলাসবহুল জীবনের মায়া কাটিয়ে বেছে নেন রবীন্দ্রযাপনকে।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ-রহমানকে একসূত্রে বাঁধলেন বাংলার একদল তরুণ শিল্পী
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের নাচ, ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শী, বললেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ
শান্তিনিকেতনে যামিনী চক্রবর্তী, নিমাইচাঁদ বড়াল, পণ্ডিত ডিটি যোশী এবং সর্বোপরি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বদের শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসাবে পেয়েছিলেন গোরা সর্বাধিকারী। পরবর্তীতে বিশ্বভারতীতেই শুরু হয়েছিল তাঁর কর্মজীবন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া তিনি তালিম নিয়েছিলেন রাগ সঙ্গীতেরও। হয়ে উঠেছিলেন ‘মোহরদি’-র ছায়াসঙ্গী। দীর্ঘ চল্লিশ বছর সঙ্গ পেয়েছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এমনকি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই বাইরের জগতে অভিষেক হয়েছিল মুখচোরা তরুণ গোরার। একাধিক সঙ্গীতানুষ্ঠানের কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গানও গেয়েছেন তিনি। কখনও আবার বাজিয়েছেন হারমোনিয়াম। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বেশ কিছু গানের রেকর্ডও। নব্বই দশকের গোড়ায় ‘অনুরোধের আসরে’-ও ধারাবাহিকভাবে শোনা যেত তাঁর গান।
সন্ধ্যা সেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আনন্দের রাজ্যে থেকেও তুচ্ছ ব্যাপারে মনোমালিন্য, দলাদলি, একের কাছে অন্যকে ছোটো করবার হীনমন্যতা আমায় হতাশ করে।’ সঙ্গীতজগতের এই রেষারেষির বাইরে গিয়ে তাই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন বর্ষীয়ান সঙ্গীতশিল্পী। খ্যাতি নয়, বরং গানের আরাধনাকে পাথেয় করেই পথ চলেছেন আজীবন। প্রিয় ‘মোহরদি’-র স্মৃতিকে আঁকড়েই নিভৃতে দিন কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনের ‘আনন্দধারা’-য়।
দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই সঙ্গীতের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এবার সকলের আড়ালে নীরবেই তিনি পাড়ি দিলেন অন্য দুনিয়ায়। শেষ হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক জীবন্ত অধ্যায়। এই প্রজন্মের ক’জনেরই কাছেই বা পরিচিত তিনি? তাঁর গান নিয়েও কি আদৌ চর্চা হবে আজ থেকে কয়েক দশক পরে? হয়তো না। তবে নিঃস্পৃহ সঙ্গীতসাধনার দৃষ্টান্ত হয়েই তিনি রয়ে যাবে রবীন্দ্রগানের দুনিয়ায়। থেকে যাবেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সন্ধ্যা সেনের স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে…
তথ্যসূত্র—
১. সুরের আগুন, সন্ধ্যা সেন
২. সপ্তর্ষি ঘটক
Powered by Froala Editor