আট বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন জ্যোতিষচন্দ্র। সরল, সুন্দর; সেইসঙ্গে অসম্ভব তীক্ষ্ণ। জ্যোতিষচন্দ্রের নিজের কথায়, “মেয়েটির ভেতর ইস্পাত আছে— শান দিলে খুব ধারালো হবে। আর্টের পুতুল না, আস্ত প্রতিমাই গড়া হবে।” ‘জয়দেব’ ছবিতে সেই আট বছরের মেয়েটিকেই দিলেন রাধিকার পার্ট। লোকে হেসেওছিল এমন কাজে। বাকিটা ইতিহাস। জানেন, কে সেই ছোট্ট মেয়েটি? ভবিষ্যতের প্রথমসারির অভিনেত্রী, কানন দেবী।
সে নাহয় হল, কিন্তু এই জ্যোতিষচন্দ্রই বা কে? তা জানতে গেলে অবশ্য উঁকি দিতে হবে ইতিহাসে। পুরো নাম জ্যোতিষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার ভাবুন তো একবার পুরনো সেই দিনের কথা! যখন প্রেক্ষাগৃহ তো দূর, চলমান ছবিও যে হতে পারে, সেই ধারণাও ছিল না মানুষের। সেটা যেন কোনো এক জাদু-দুনিয়ার গল্প! ছবিও নাকি চলছে! একসময়, সেটাও শুরু হল। বাংলা প্রথম সাক্ষী থাকল নির্বাক চলচ্চিত্রের। প্রেক্ষাগৃহে বসে দর্শকরা উপভোগ করলেন সেটা। আর এই পুরো কর্মকাণ্ডের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ইতিহাস হয়ে গেলেন আরও এক মানুষ। বিংশ শতকের প্রথম দিকে তাঁর পরিচালিত সিনেমাগুলি বাংলায় সাড়া জাগিয়েছিল। তিনিই জ্যোতিষচন্দ্র।
বাঙালির হাত ধরেই কিন্তু ভারত দেখেছিল প্রথম সিনেমা, অর্থাৎ চলচ্চিত্র। সৌজন্যে, হীরালাল সেন। বিংশ শতকের শুরুতে বাংলাও সাক্ষী থাকল সেই দৃশ্যের। থিয়েটার, যাত্রা থেকে বিনোদন হাজির হল রিলে। সেখানেই অন্যতম ভূমিকা নিলেন জ্যোতিষচন্দ্র। হাত ধরলেন জে. এফ. ম্যাডান এন্ড কোং-য়ের। ধীরে ধীরে ভারতের নির্বাক চলচ্চিত্র জগতে অন্যতম নাম হয়ে উঠলেন তাঁরা। আর এই নৌকায় অন্যতম মাঝি ছিলেন জ্যোতিষ। হাওড়ায় জন্ম, সেখানেই আমৃত্যু থাকা। একটা সময় বাংলার পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, অভিনেতা-সহ অন্যান্য কলাকুশলীরা হাওড়ারই বাসিন্দা ছিলেন। সেখানকারই সুযোগ্য সন্তান ছিলেন এই পরিচালকটিও।
চলচ্চিত্র পরিচালনার হাতেখড়ি হয়েছিল ‘সতীলক্ষ্মী’র মাধ্যমে। তারপর থেকে একের পর এক হিট ছবি তৈরি করতে লাগলেন তিনি। জ্যোতিষচন্দ্র ছিলেন এক কথায় ম্যাডান কোম্পানির ‘জহরত’। অবশ্য তাঁর কথা বলতে গেলে দুটি জিনিসের দিকে নজর না রাখলেই নয়। ওই সময় ‘জয়দেব’ বলে একটি সিনেমা তৈরি করেন তিনি। এখনকার ভাষায় বললে, সিনেমাটি রীতিমতো সুপারহিট হয়। কি অভিনয়, কি নির্দেশনা— সবেতেই দর্শকদের মন জিতে নিয়েছিল ছবিটি। শুধুমাত্র এই একটি ছবি থেকেই সাত লাখ টাকা কামিয়েছিল ম্যাডান কোম্পানি। যা তখনকার হিসেবে অনেক!
আরও পড়ুন
কবিতা থেকে সিনেমা - সর্বত্রই নতুন ভাষা খুঁজেছেন বুদ্ধদেব
পরিচালক সম্পর্কে স্বয়ং কানন দেবীর মতামতও ছিল শ্রদ্ধার। “জয়দেব চিত্রে রাধার ভূমিকায় আমার শিল্পী জীবন শুরু হল।… আমার ওপর বিধাতার অসীম করুণা যে একেবারে প্রথমেই জ্যোতিষবাবুর মতো হৃদয়বান মানুষের কাছে কাজ করবার সুযোগ পেয়েছি। উনি যেমন স্নেহপ্রবণ ছিলেন, তেমনি ছিলেন নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি কঠোর।” নিজের ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে জ্যোতিষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এমনই মন্তব্য ছিল তাঁর।
আরও পড়ুন
সিনেমা নির্মাণের শেষে মৃত্যু নায়কের, হত্যা-মামলায় অভিযুক্ত প্রযোজক!
আদ্যোপান্ত সিনেমা-অন্ত প্রাণ ছিলেন জ্যোতিষবাবু। আর সেই কাজই তাঁর জীবনের শেষক্ষণ ডেকে আনল। তখন ‘নূরজাহান’ ছবির শ্যুট চলছে। শোন ব্রিজের ওপর ছবি তুলতে গিয়েছেন জ্যোতিষচন্দ্র। হঠাৎই টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যান তিনি। দেড় বছর বিছানায় পড়েছিলেন তিনি। প্রিয় গুরুকে দেখার জন্য হাওড়ার বাড়িতে প্রায়ই আসতেন কানন দেবী। অর্থ সাহায্যও করেছিলেন। সেই হাওড়ার বাড়িতেই চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন বাংলার নির্বাক ছবির অন্যতম সফল পরিচালক।
আরও পড়ুন
অস্কারের মনোনয়নে প্রথম সিনেমাই; রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতেন মহিলা-ভক্তরা!
শেষে এসে, খানিক অবাকই লাগে না! যে মানুষটি বাংলা ছবির শুরুর লগ্ন থেকে যুক্ত ছিলেন, কানন দেবীর মতো এক প্রতিভাকে হারিয়ে যেতে দেননি যিনি, তুলে এনেছেন ভারতের সামনে; তাঁকে কি স্মরণে রেখেছে সিনেমার জগত? স্মরণে রেখেছি আমরা? পুরনো রিলগুলো হারিয়ে যাওয়ার সময়ই কি নিজেও ইতিহাসের অন্ধকার গলিতে পথ হারিয়ে ফেললেন জ্যোতিষচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়? আসুন, এই মানুষদের খানিক খুঁজে দেখার চেষ্টা করি আমরা…
Powered by Froala Editor