গতমাস থেকেই বারবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে তাঁর। মাঝে সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছিলেন। কিন্তু আবারও রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। ধরা পড়েছিল ইন্টারটিশিয়াল লাং ডিজিজ বা আইএলডি-র মতো রোগ। ফুসফুসেও ছড়িয়ে পড়েছিল সংক্রমণ। ভেন্টিলেশনে ভর্তি হতে হয়েছিল তাঁকে। শেষরক্ষা হল না আর। আজ সকালেই মৃত্যু হল সঙ্গীতশিল্পী (Music Artist) প্রশান্ত ভট্টাচার্যের (Prasanta Bhattacharya)। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। একরকম লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই বিদায় নিলেন তিনি। অথচ একসময় তাঁর কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়েছিল সীমান্ত পেরিয়ে দুই বাংলাতেই। অসমের বাঙালিদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিলেন যাত্রাদলের সুবাদে। আর রেডিওয় তাঁর গান শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন শ্রোতারা। তবু মৃত্যুর আগে যোগ্য সম্মান পেলেন না প্রশান্ত ভট্টাচার্য।
সময়টা ছিল সত্তরের দশক। বাংলাজুড়ে তখন উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একদিকে নকশাল আন্দোলন, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আগুন ঝরানো সেই দিনগুলোতে নিজের সৃষ্টিকে সঙ্গী করেই লড়াইয়ের মাঠে নেমে পড়েছিলেন প্রশান্ত। বাংলার গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে গিয়েছেন যাত্রার দল নিয়ে। সিনেমা বা নাটক মানুষ দেখতেন, আজও দেখেন। কিন্তু যাত্রা ছিল সবসময়ই শোনার বস্তু। সেখানে গানের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে নতুন ধারার যে যাত্রাপালার জন্ম হয়েছিল, তাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল গণসঙ্গীত। সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্যকে পৌঁছে দেওয়াই ছিল সেইসব যাত্রার উদ্দেশ্য।
এমনই এক কিংবদন্তি যাত্রাপালা ছিল তরুণ অপেরার ‘লেনিন’। ২ হাজার রাত চলেছিল সেই যাত্রার অভিনয়। শুরুতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তারপর সেই দায়িত্ব এসে পড়ে প্রশান্ত ভট্টাচার্যের কাঁধে। কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু প্রশান্ত সেই দায়িত্ব পালন করেছেন গুরুপ্রণামের মতো করেই। আর হেমাঙ্গ বিশ্বাসও প্রশংসা করেছিলেন তাঁর কাজের। অবশ্য শুধু যে যাত্রার আসর মাতিয়ে রাখতেন, তা তো নয়। অল ইন্ডিয়া রেডিওর অন্যতম কণ্ঠ ছিলেন প্রশান্ত। ‘অনুরোধের আসর’ অনুষ্ঠান তাঁকে বাড়তি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।
রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে লোকগান, কোথাও একটুও থমকাতে হত না তাঁকে। গানের শিক্ষার শুরুটা অবশ্য হয়েছিল বাড়ি থেকেই। পরে নানা কিংবদন্তি শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছেন। পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুচিত্রা মিত্রের কাছে সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন দীর্ঘদিন। পরবর্তীকালে খোদ রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখেছেন। শুধুই রবীন্দ্রনাথের ভাইপো নন, সৌমেন্দ্রনাথ ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক। তাঁর রাজনৈতিক মতের ছাপও তাই পড়েছিল প্রশান্তর মধ্যে।
এভাবে একটু একটু করে সঙ্গীতকেই পেশা হিসাবে বেছে নিচ্ছিলেন প্রশান্ত। এর মধ্যে জামশেদপুরে অল ইন্ডিয়া রেডিওর শাখা খোলা হলে সেখানে প্রথম অনুষ্ঠানও করেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য। আর এসবের মধ্যেই এসে পড়ে সত্তরের দশক। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বামপন্থী আদর্শের কথা যেমন প্রচার করেছেন, তেমনই যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামেও। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শিল্পী আব্দুল জব্বর, আপ্পেল মাহমুদের সঙ্গে মিলে কনসার্টের আয়োজন করেন তিনি। আর সেই কনসার্ট থেকে উপার্জিত সমস্ত অর্থ পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
সময়ের নিয়মেই যেন এরপর হঠাৎ হারিয়ে গেলেন প্রশান্ত। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল তাঁর শিল্পধারাও। যাত্রাপালার জনপ্রিয়তাকে গ্রাস করল টেলিভিশন। আর রেডিওয় একই শিল্পীর গলায় পরপর নানা ধরনের গান শোনার অভ্যাসও হারালেন শ্রোতারা। বরং দফায় দফায় রেকর্ড বদলে দেওয়াই দস্তুর হয়ে উঠল। আর এখন তো গান শোনার জন্য রেডিওর অপেক্ষাও করতে হয় না। তবে সংস্কৃতি জগতের ইতিহাসে সেই সময় সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়ে সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ আদানপ্রদানের সম্পর্কটিও। প্রশান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসেরই প্রতিনিধি। বর্তমান সংস্কৃতি জগত হয়তো তাঁর প্রয়াণে খুব বেশি শোকপ্রকাশ করবে না। কিন্তু ইতিহাস যে অনেকটাই রিক্ত হল, সে-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
Powered by Froala Editor