কম্পিউটারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মাউস। ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের জন্য তৈরি হয়েছিল কম্পিউটারের এই অঙ্গ। ১৯৬৩-র সেই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন দুই বিজ্ঞানী। উইলিয়াম ইংলিশ এবং ডাগ এঞ্জেলবার্ট। মাউসের পরিকল্পনা করেছিলেন এঞ্জেলবার্ট। এবং সেই পরিকল্পনার রূপদান করেন ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ইংলিশ। ২০১৩-তে মারা গিয়েছিলেন এঞ্জেলবার্ট। এবার চলে গেলেন মাউসের আরেক স্রষ্টা উইলিয়াম ইংলিশও। যিনি বিল ইংলিশ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন।
গত ২৬ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিল ইংলিশ। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। সম্প্রতি তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে স্ত্রী জানান তাঁর মৃত্যু সংবাদ। জানা গেছে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মৃত্যু হয় কম্পিউটার জগতের অন্যতম এই ইঞ্জিনিয়ারের। তবে আধুনিক কম্পিউটারের এই পথিকৃত্যের মৃত্যুতে কোনো সাড়া পড়েনি কোনো। অনেকটা নীরবেই এই চলে যাওয়া।
বর্তমানে প্রায় সবক্ষেত্রেই লেসার মাউস ব্যবহৃত হয়। ল্যাপটপের ক্ষেত্রে তা আরোই উন্নত হয়ে পাল্টে গেছে টাচপ্যাডে। এর আগে শূন্যের দশকে অনেকেই ব্যবহার করেছেন রোলিং বল যুক্ত মাউস। তবে বিল এবং এঞ্জেলবার্ট যে মাউস তৈরি করেছিলেন তার চেহারার সঙ্গে আজকের মাউসকে মিলিয়ে নিয়ে বেশ অসুবিধাই হবে সকলের। কারণ সেই মাউস ছিল আদতে একটা কাঠের বাক্স। যার ওপরে ছিল একটাই মাত্র স্যুইচ। তলায় যুক্ত ছিল ৯০ ডিগ্রি কোণে থাকা দুটি চাকা। যাদের একটির মাধ্যমে কেবলমাত্র পাশাপাশি সরা যেত। অন্যটির মাধ্যমে উপর-নিচে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে এই মাউসের চেহারাও।
তবে সব থেকে মজার কথা, তার নামও তখন ‘মাউস’ হয়ে ওঠেনি। ‘আ ব্রাউন বক্স উইথ আ বাটন’। জন্মকালে এমনই শক্ত এবং দীর্ঘ ছিল মাউসের নাম। একটি সম্মেলনে এঞ্জেলবার্ট এই যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন একটি ব্যাখার। গণিতের রেখাচিত্রের সাহায্য নিয়েই বলেছিলেন যন্ত্রটির উপর-নিচ বা পাশাপাশি চলনের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যেতে পারে মনিটারে দেখতে পাওয়া কোনো বিন্দুর অবস্থান। চিহ্নিত করা যেতে পারে কোনো শব্দ বা বর্ণকে। তবে ‘মাউস’ নামটি ঠিক কীভাবে এসেছিল সে ব্যাপারে পরবর্তীকালে স্পষ্ট স্মৃতিচারণ করতে পারেননি দুই স্রষ্টাই। একটি প্রচলিত কথা অবশ্য রয়েছে। তখন কারসারকে নাকি বলা হত ‘ক্যাট’। আর এই কার্সার বা ‘ক্যাট’ নতুন তৈরি এই যন্ত্রের পরিচলনকে ধাওয়া করত বলেই, যন্ত্রের নাম হয়ে যায় ‘মাউস’।
মাউসের জন্ম হয়েছিল স্টানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। ১৯৭১ সালে সেই গবেষণাকেন্দ্র ছেড়ে ইংলিশ যোগদান করেছিলেন ‘জেরক্স’ কোম্পানিতে। সেখানেই আধুনিক কম্পিউটারের রূপদান করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গেই মাউসের চাকা দুটি পাল্টে ব্যবহার করলেন রোলিং বল। যা পরবর্তী তিন দশক অবধি ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। তবে একই সময়ে জার্মান কোম্পানি টেলিকোমফুন এই প্রযুক্তিকে তৈরি করেছিল ভিন্নভাবে।
আরও পড়ুন
মানসিক ভারসাম্য হারালেন লকডাউনে, কলকাতায় আত্মহত্যার চেষ্টা ইঞ্জিনিয়ারের
তবে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য বিপুল অর্থাগম হয়েছিল এই দুই বিজ্ঞানীর, এমন ভাবলে বড়ো ভুল করা হবে। কেবলমাত্র পেটেন্টেই রয়ে গেছে তাঁদের নাম। জেরক্সের তৈরি করা রোলিং বল মাউসের জন্য দুই বিজ্ঞানীর ভাগ্যে জুটেছিল মাত্র ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। পরবর্তীকালে জনপ্রিয় কোম্পানি ‘অ্যাপেল’ এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছিল অন্যভাবে। তার জন্য কোনো স্বীকৃতিই পাননি এই দুই গবেষক। পাননি কোনো আর্থিক সাম্মানিকও। লাইট পেন কিংবা জয়েস্টিকের মত যন্ত্রও তৈরি হয় এই প্রযুক্তির ওপরেই ভিত্তি করে। কিন্তু আমরা কি মনে রাখতে পেরেছি তাঁদের নাম? কম্পিউটারের ছাত্রছাত্রী ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো বিশেষ জানবেও না এই দুই কিংবদন্তির নাম। ইংলিশের নীরব চলে যাওয়া এই প্রশ্নই রেখে গেল সকলের কাছে...
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা চিফ ইঞ্জিনিয়ার তিনি, বানিয়েছেন ৩৫টিরও বেশি ব্রিজ
Powered by Froala Editor