ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে রয়েছে এই দামাল প্রাণীটির কদর। হাতি (Elephant)। হস্তী। পিল। দ্বিপ। ঐরাবত। গজ। বহু নামের সমার্থকে সে অভিসারক। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে বিভিন্ন চিত্র, ভাস্কর্য, এমনকী মুদ্রায় শোভা পেয়েছে হাতি। এই নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় ভারতীয় মুদ্রায় (Coin) হাতি।
ভারতের উপজাতীয় রাজ্যগুলিকে ডাকা হত জনপদ নামেও। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই জনপদগুলি। এই সকল জনপদ, মহাজনপদ এবং পরবর্তীকালে মৌর্যদের পঞ্চ-চিহ্নিত মুদ্রার এক পিঠে পাঁচটি প্রতীক ছাপ এবং অপর পিঠ থাকত ফাঁকা। যদিও মাঝেমধ্যেই মাত্র একটি ছাপ শোভা পেত উলটো পিঠে। ছাপগুলির মধ্যে সূর্য, ষড়ভুজ, পাহাড়, হাতি, গরু, মাছ ইত্যাদি প্রতীকের দেখা মেলে।
ভেমাকি: উত্তর ভারতের একটি প্রাচীন ভারতীয় উপজাতি রাজ্য এই ভেমাকি। এই জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারত এবং বৃহৎসংহিতায়। এখানকার মুদ্রাগুলিকে সাধারণত চারটি স্বতন্ত্র ধারায় চিহ্নিত করা হয়। এরমধ্যে কিছু মোটিফ অনুসারে শ্রেণিবদ্ধ। হাতি সেই মুদ্রাগুলির উপর আবর্তক প্রতীক (Recurring symbol)।
এখানকার রুপোর এক প্রাচীন মুদ্রা রাজা মহাদেবের আমলের। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ছিল তাঁর রাজত্ব। মুদ্রাটির ওজন প্রায় ২.২৮ গ্রাম। এর উলটো পিঠে কুঁজবিশিষ্ট একটি ষাঁড় রয়েছে ডানদিকে। সামনে একটি চাকাসহ খরোষ্ঠী 'ভাগবত মহাদেবসা রাজারাজা' বিরাজমান। বিপরীতেই একটি হাতি মুদ্রার রূপ বাড়িয়েছে। তার অবস্থান বাঁ-দিকে। হাতির সামনে একটি ত্রিশূল এবং ব্রাহ্মী কিংবদন্তি 'ভাগবত মহাদেবসা রাজারাজা'।
আরও পড়ুন
বিদেশি মুদ্রা থেকে বিরল ডাকটিকিট, সংগ্রাহকদের শেষ ঠিকানা বিবাদী বাগের বিমান কবিরাজ
বৃষ্ণি: যদুবংশ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বংশ বৃষ্ণি প্রাচীন ভারতের এক উপজাতীয় রাজ্য। পুরাণ অনুযায়ী, দ্বারকার কাছাকছি এহেন বৃষ্ণি। এখানকার মানুষ যদু বংশধর। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে ব্যাসের মহাভারত সবেতেই এই জনপদের উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন
স্বাধীন এই দেশে বাস করে মাত্র একটি পরিবারই, রয়েছে নিজস্ব পতাকা ও মুদ্রা
পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে আলেকজান্ডার কানিংহামের পাওয়া রাজা বৃষ্ণির একটি রৌপ্য মুদ্রায় অদ্ভুত এক পৌরাণিক প্রাণী দেখা যায়। এর অর্ধেক সিংহ এবং অর্ধেক হাতি।
পশ্চিমি স্যাটাপস (পশ্চিমি ক্ষত্রপস): সম্ভবত সিথিয়ান বংশোদ্ভূত রাজবংশ পশ্চিম ক্ষত্রপ পশ্চিম ভারতে ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি প্রধান শাসক রাজবংশ ছিল। এই রাজবংশ মুদ্রার ক্ষেত্রে তাদের অসাধারণ ধারাবাহিকতার জন্যও পরিচিত।
দামসেনের শাসনামলের একটি পোটিন মুদ্রার ডানদিকে একটি হাতি দণ্ডায়মান। উপরে সূর্য ও চাঁদ তার বিপরীতে। উলটো দিকে তিন-খিলানযুক্ত পাহাড়, নীচে নদী। এরও উপরে অর্ধচন্দ্র এবং সূর্য। মুদ্রাটি ১৫৩ শকাব্দের।
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হাতি। চোল, চেরা এবং পান্ড্য রাজবংশের কথা বলতেই হয়। প্রত্যেকটিই সঙ্গম যুগে বিকশিত। সাহিত্য ও শিল্পের দিক থেকেও উৎকর্ষ সাম্রাজ্যগুলি। এখানকার মুদ্রাগুলির নকশা ও ধাতুর বৈচিত্র্য তাক লাগিয়ে দেয়। মুদ্রায় হাতি তার আপন গুণে সত্য।
চোল: চোল সাম্রাজ্যের এক তাম্রমুদ্রায় একটি হাতি তার বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। এর বিপরীতে রয়েছে বাঘ। সে দাঁড়িয়ে বাঁ-দিকে মুখ করে। বর্গাকার এই মুদ্রার ওজন ২.৫৬ গ্রাম।
চেরা: প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের তিনটি বিশিষ্ট রাজবংশের মধ্যে অন্যতম চেরা রাজবংশ। এই রাজবংশের একটি তামার মুদ্রায় হাতি বর্তমান। মুদ্রার ওজন ৬.৯ গ্রাম। তাতে ছ’টি ধনুকাকৃতি পাহাড়ের সামনে ডানদিক দিয়ে একটি হাতি হাঁটছে। রয়েছে তির-ধনুক, সাপ এবং যুদ্ধের কুঠার। এগুলি হাতিটির উলটো দিকে চিত্রিত।
পান্ড্য: ইতিহাসবিদরা বলছেন, শ্রীলঙ্কায় পাওয়া প্রাচীন মুদ্রা পান্ড্য রাজবংশের। তামার এই মুদ্রার ওজন ২.৫ গ্রাম। মুদ্রার উলটো দিকে বাঁ-দিকে হাতি ও মাছ।
সঙ্গম যুগের মুদ্রা প্রাচীন তামিল ইতিহাসের উৎস অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে মজার ব্যাপার, এই রাজবংশের মধ্যযুগীয় সময়ে তৈরি করা মুদ্রায় হাতি প্রায় বিরল হয়ে যায়। কিন্তু ভারতীয় মুদ্রায় হাতির যাত্রা এখানেই শেষ নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগেও দক্ষিণের বিভিন্ন রাজবংশের মুদ্রায় হাতিদের ফুটিয়ে তোলা অব্যাহতই।
রাজা জয়শ্রয় মঙ্গলারসার ‘বাদামি চালুক্য’ মুদ্রার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরসীম। জয়শ্রয় ৫৯৬-৬১০ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করতেন। চালুক্যরা উত্তর মহারাষ্ট্র ও দক্ষিণ গুজরাত অঞ্চলে শাসন করত। এই তাম্রমুদ্রার উলটো দিকে একটি হাতি ডানদিকে মুখ করা। বিপরীতে সূর্যের অধিষ্ঠান।
চালুক্যদের আরেকটি শাখা, গুজরাতের সোলাঙ্কি চালুক্য বা পরবর্তী চালুক্য নামে পরিচিত। তাদের মুদ্রাতেও হাতি রয়েছে। ০.৩৮ গ্রাম ওজনের এই রৌপ্য মুদ্রা রাজা সিদ্ধরাজ জয়সিংহের। মুদ্রার উলটো দিকে একটি হাতি ডানদিকে হাঁটছে। মাটি ছুঁয়েছে তার দীর্ঘ শুঁড়।
রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশ ১১ এবং ১২ শতকে আধুনিক ছত্তিশগড়ের কিছু অংশ শাসন করেছিল। রত্নপুরার কালাচুরি শাসকরা সোনা, রুপো এবং তামার মুদ্রা জারি করেছিলেন। যিনি পেশ করতেন, এই মুদ্রা তাঁর নামই বহন করত। মুদ্রাগুলির মৌলিক চারটি নকশার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘গজ শার্দূলা’। বাঘ এবং হাতির মধ্যে লড়াইয়ের দৃশ্য প্রায়শই দেখা যেত মুদ্রাগুলিতে।
রাজা জজ্জলা দেব দ্বিতীয়ের মাশা স্বর্ণমুদ্রাও উল্লেখযোগ্য। ছোট্ট সীমানার মধ্যে একটি গজ-শার্দূল (একটি হাতির উপর বসানো একটি বাঘ) বৈশিষ্ট্যের। এর ওজন ৩.৮ গ্রাম। মুদ্রার বিপরীতে দেবনাগরী লিপিতে দু-লাইনে লেখা ‘শ্রী মাত জজ্জলা দেবা’।
পশ্চিমি গঙ্গার মুদ্রাতেও হাতি রয়েছে। তারা প্রাচীন কর্নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ শাসক রাজবংশ। ৩.৭৪ গ্রামের সোনার মুদ্রায় একটি ক্যাপ্যারিজনড হাতি চিত্রিত। দক্ষিণের পরাক্রমশালী রাজবংশ রাষ্ট্রকূটদের মুদ্রায় হাতি বিদ্যমান। হাতি এখানে পরম শক্তির প্রতীক। এদেরই একটি রুপোর ০.৪৬ গ্রাম ড্রামা কয়েনের উলটো দিকে একটি হাতি ডান দিকে হাঁটছে। রয়েছে একটি মানব চিত্রও (সম্ভবত রাজা বা মাহুত)। হোয়সালা ও কাকাতিয়া রাজবংশের কিছু মুদ্রাতেও হাতি চিত্রিত।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মুদ্রায় হাতি পরিলক্ষিত হয়। দ্বিতীয় দেব রায় (রাজত্বকাল: ১৪২২-১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দ) তাম্রমুদ্রার উলটো দিকে হাতির উপরে 'LA' অক্ষরসহ বাহ্যিক অলংকরণ শোভা পেয়েছে। ফ্রেমটি বৃত্তাকার। এর মধ্যেই একটি হাতি।
মহীশূর রাজ্যের ‘টাইগার অফ মাইসোর’ টিপু সুলতান একজন কিংবদন্তি শাসক। তিনি শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেননি, বরং ব্রিটিশ বাহিনীকে দক্ষিণ ভারত থেকে দূরে রাখতেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবনী প্রশাসনিক পরিকল্পনা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। সামরিক প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য পরিচিত ছিলেন টিপু।
তাঁর সাম্রাজ্যের ওথমানি/ডবল পয়সা একটি তাম্রমুদ্রা। মুদ্রাটি ১২১৮ মালগুড়ি বছরে তৈরি। এর উলটো দিকে একটি হাতি শুঁড় উঁচিয়ে। ডান দিকে তার মুখ। হাতির উপরে পতাকা। তারিখ ১২১৮ লেখা রয়েছে লেজে। পুরোটাই একটি ডবল রেখাযুক্ত বৃত্তের মধ্যে। মাঝখানে একটি সারি বিন্দু। বিপরীতে ফারসি শিলালিপিতে লেখা— ‘ওথমানি পাত্তান জারব দারুল সুলতানাত’।
আধুনিক যুগেও মুদ্রায় হাতি চিত্রিত করার উত্তরাধিকার রক্ষিত। ত্রিবাঙ্কুরের রাজপরিবারের মহারাজা কার্তিকা থিরুনাল রামা ভার্মার ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে জারি করা মুদ্রায় একজন (পুরুষ/ যোদ্ধা বা মাহুত) অঙ্কুশকে ধরে রেখেছেন। অঙ্কুশ শব্দের অর্থ মাহুতের ব্যবহৃত হস্তিতাড়নযন্ত্র। কেমন দেখতে এই যন্ত্র? আঁকশির মতো। মুখটা ছুঁচলো ও বাঁকা। লোহার তৈরি এই বিশেষ অস্ত্র দিয়ে হাতির মাথায় খোঁচা দেওয়া হয়। আর এই অস্ত্র গ্রহণ করবার কৌশল জানে যে, সে-ই অঙ্কুশগ্রহ। সেই অঙ্কুশগ্রহ অর্থাৎ মাহুত। মুদ্রায় বৃত্তাকার সীমানার মধ্যে বাঁ-দিকে বিশাল এক হাতি। এর মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্মও।
সৌভাগ্যের প্রতীক হাতি। ভারতীয় মুদ্রা সংস্কৃতি বুঝতে গেলে ধর্মীয়, সামাজিক প্রেক্ষাপটকে উপলব্ধি করাটাও জরুরি। মুদ্রার হাতি আসলে সৌভাগ্যের সঙ্গে শক্তিকেও রূপ দেয়। ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে কিংবা রাজবংশের শক্তি বোঝাতেও এর কোনো জুড়ি নেই। ভারতীয় প্রজতন্ত্রের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী পশু শূণ্ডধারীকে নিয়ে তাই হয়তো এত আয়োজন।
ছবি : প্রতীকী
Powered by Froala Editor