বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় (Babul Supriya) জয়ী হয়েছেন। যদিও গতবারের নির্বাচনে প্রয়াত সুব্রত মুখার্জীর জেতা ভোটের তুলনায়, তা কম, তবুও তিনি জিতেছেন। নাগরিক সমাজের একাংশ বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে ‘বাবুলকে ভোট নয়’ এই শ্লোগান তুলেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাবুল জিতেছেন। অনেকে বলতে পারেন, বাবুল সুপ্রিয় কেন, এই মূহূর্তে যে-কেউ তৃণমূলের হয়ে বাংলায় নির্বাচনে প্রার্থী হলে জিতবেন, কারণ এই সময়ে নির্বাচন মেশিনারির অনেকটাই তৃণমূল কংগ্রেসের আয়ত্বে। কিন্তু কোনো-কোনো মানুষ বলছেন, বাবুল সুপ্রিয়-র এই জিত আসলে, ঘুরিয়ে বিজেপিরই জিত। এই জয় আসলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই (Communal Politics) জয়।
এই নির্বাচনে যখন বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে বামেদের তরফে সায়রা শাহ হালিমকে প্রার্থী করা হয়েছিল, তখনও আমার জানা ছিল না, এই নির্বাচনটিকে আমি এতোটা আমার নিজের ব্যক্তিগত লড়াই হিসেবে দেখব। কয়েকদিন আগে এক সাংবাদিক সায়রা শাহ হালিমকে নিয়ে একটি খবর করেন, সেটা টুইট করতে গিয়ে আমি দেখি যে সায়রা আগে থেকেই আমাকে টুইটারে ফলো করেন, আমি জানতাম না। তিনি বিজেপিকে ভোট নয়, এবং নাগরিকত্ব বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গেও ছিলেন। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ ছিল না, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এই মানুষটি হয়তো বাবুল সুপ্রিয়কে লড়াই দিতে পারবেন, এবং বিজেপি-ফেরত বাবুলের বা গেরুয়া বসন খুলে রেখে আসা বাবুল সুপ্রিয়-র খামতিগুলোকে মানুষের সামনে হয়তো নিয়ে আসতে পারবেন সায়রা। আমি সায়রার ফোন নম্বর জোগাড় করে, নিজের পরিচয় দিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ করি, বলি কথা বলতে চাই। ওদিকে তখন আমার মতো বাবুলকে হারাতে হবে, এই ভাবনার সঙ্গে একমত হয়ে সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়, শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত সহ আরও বেশ কিছু মানুষজনও একজোট হচ্ছেন। একটা মিটিং ডাকা হল, আমরা কি করতে পারি, তা নিয়ে। জনা পনেরো মানুষ উপস্থিত হলেন সেই মিটিং-এ। সেদিনই রামপুরহাটে বগটুই ঘটে গেছে, গোটা বিষয়টা বাবুল সুপ্রিয়র থেকে ঘুরে গেল, রাজনৈতিক হিংসার দিকে। সই সংগ্রহ হল রামপুরহাট সহ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে, পথেও নামা হল বেশ কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে। বাবুল সুপ্রিয় সংক্রান্ত আলোচনা ক্রমশ হারিয়ে গেল, অন্যান্য ঘটনার মধ্যে। কিন্তু আমরা তাও ভাবছিলাম কী করা যায়? এরইমধ্যে একই দাবি নিয়ে প্রসেনজিত বসু এবং এনআরসি বিরোধী বেশ কিছু সংগঠন এবং মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাঁরাও বললেন, ‘বাবুলকে ভোট নয়— বিজেপিকে ভোট নয়’ এই শ্লোগান তুলতে হবে, শুধু সামাজিক মাধ্যমে নয়, প্রচারপত্র বিলি করতে হবে, এমনকি মিছিলও করতে হবে। সেই মতো একটা তারিখ ঠিক করা হল, ১ এপ্রিল পার্কসার্কাস থেকে একটি মিছিল বেরোবে। কিন্তু সেই মিছিল শুরু করবার আগেই, সেদিনই গ্রেপ্তার করা হল ২৬ জন সংগঠককে।
এরই মধ্যে সায়রা আমায় ফোন করলেন, আমায় বললেন, ডঃ ফুয়াদ হালিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি পরদিন যোগাযোগ করব বললাম, কিন্তু তারপর দেখলাম ফুয়াদ হালিম নিজেই আমায় ফোন করলেন। আমি বললাম, আমরা একটা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ‘বাবুলকে ভোট নয়— বিজেপিকে ভোট নয়’ এই নিয়ে মিছিল করতে চাই। উনি রাজি হলেন, কিন্তু মনে হল, উনি খুশি হতেন, যদি আমরা সরাসরি সায়রাকে ভোট দিন, এই দাবিতে মিছিল করতাম, কিন্তু তা সত্ত্বেও উনি রাজি হলেন। তখনও এক তারিখের মিছিল থেকে গ্রেপ্তারির ঘটনা ঘটেনি। সেই গ্রেপ্তারির পরে, প্রসেনজিত বসু সহ অন্যান্য আরও বেশ কিছু রাজনৈতিক সামাজিক কর্মীরা ঠিক করলেন, তাঁরা সরাসরি সায়রা শাহ হালিমের সমর্থনে মিছিল করবেন, ৭ এপ্রিল। সেই মতো তাঁরা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েও দিলেন। সেদিন একটি মিটিং হল সায়রার বাড়িতে, সেখানেও আমি বললাম, সবাই তো সরাসরি ‘সায়রাকে ভোট দিন’ বা ‘ভোট ফর লেফট’ নাও বলতে চাইতে পারেন, তাই আমরা বললাম, আমরা আরও একটা মিছিল করব ৮ এপ্রিল, যেখানে শুধু বলা হবে বাবুলকে ভোট নয় এবং বিজেপিকে ভোট নয়। ফুয়াদ হালিম রাজি হলেন, বললেন, অনুমতি নিতে হবে কিন্তু প্রার্থীর নামে, নাহলে সমস্যা হতে পারে আবারো। আমরা রাজি হলাম। যদিও ঘটনাচক্রে কোনও মিছিলের অনুমতিই কলকাতা পুলিশ দেয়নি, তখনই আমার একটা কথা মনে হল, সিপিআইএম কি আদৌ জিততে চায়? তাঁরা কি আদৌ কৌশল বোঝেন? যে সময়টা আমরা ‘বাবুলকে ভোট নয়’ বলছি, তখন সিপিআইএমের একাংশ কেন আমরা সরাসরি ‘বামেদের ভোট দিন’ বা ভোট ফর লেফট’ বলছি না, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম কাঁপিয়ে তুললেন, কেন আমরা সরাসরি তৃণমূলকে আক্রমণ করছি না, কেন শুধু বাবুল সুপ্রিয়কে আক্রমণ করছি, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন। যদি খেয়াল করা যায়, সেই সময়ে সিপিআইএমের পার্টি কংগ্রেস চলছে, হয়তো বেশিরভাগ নেতা-নেত্রীরা রাজ্যের বাইরে, কিন্তু তাও কেন কলকাতা পুলিশ অনুমতি দিচ্ছে না, বা কেন বামেদের প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে বামেদের নেতৃত্ব খুব বেশি সরব হননি। আরও একটু যদি আন্তরিক হতেন, বাবুলকে ভোট নয় এই শ্লোগানকে যদি আরও একটু জোরের সঙ্গে তুলে ধরতেন, আমি নিশ্চিত আজকে বালিগঞ্জের ফল অন্যরকম হত। শুধুমাত্র দুটো ওয়ার্ড নয়, হয়তো বা সব কটা ওয়ার্ডেই জয়ী হতেন।
একটু পিছন ফেরা যাক
২০১১ সালের আগে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ঘটে গেছে। কলকাতা শহর বড়ো বড়ো মিছিল দেখে ফেলেছে। হঠাৎ একদিন কলকাতা শহর জুড়ে দেখা গেল, বেশ কিছু বিশিষ্ট মানুষজনের মুখ সম্বলিত ব্যানার, তাতে লেখা ‘পরিবর্তন চাই’। সেই হোর্ডিং বা ব্যানারে কিন্তু কোথাও লেখা নেই, কাকে ভোট দিয়ে এই পরিবর্তন আসবে, কিন্তু মানুষের মনে সেই শ্লোগান ঢুকে গেল। তারপর আবার যখন ২০২১ সালে দেখা গেল বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় চলে আসতে পারে, তখন আবার নাগরিক সমাজের তরফে আওয়াজ উঠল, বিজেপিকে ভোট নয়, এবারও কিন্তু বলা হয়নি, বিজেপির বিরুদ্ধে কাকে ভোট দিতে হবে? কিন্তু বামেরা আবারও বলা শুরু করলেন, এই শ্লোগান ঘুরিয়ে তৃণমূলকে সমর্থনের কথা বলা হচ্ছে। অথচ কৌশলী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করলেন, একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেই দিলেন, যাঁরা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ বলছেন, তাঁরা ভালো কাজ করছেন, অর্থাৎ সুকৌশলে এই শ্লোগানটিকে নিজের স্বপক্ষে নিয়ে নিলেন, যে সময়ে আক্রমণের বর্শামুখ বিজেপির বিরুদ্ধে হওয়ার কথা, বামেরা তখন একের পর এক আক্রমণ করতে লাগলেন, কারা বিজেপিকে ভোট নয় এই শ্লোগান তুলছেন, তাঁদেরকে। এবারও কেন ভোট ফর লেফট বা কেন সরাসরি তৃণমূলকে হারানোর কথা বলা হচ্ছে না, সেই বিতর্ক শুরু করলেন, ফল যা হওয়ার তাই হল।
আজকে যাঁরা ভাবছেন, এই ফলাফল বামেদের পুনরুত্থানের সুচনা, তাঁরা আবারও ভুল করছেন। এতটাও হয়নি, হলে আসানসোলের ফল অন্যরকম হত। আসলে অদলীয় নাগরিক পরিসরের জায়গাটাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অদলীয় নাগরিক সমাজের আওয়াজটা শুনতে হবে, তবেই বোঝা যাবে সমাজ কী চায়? যদি তা না হয়, তাহলে বাম রাজনীতি কিন্তু একই পরিসরে ঘুরপাক খাবে, লাভ হবে না। রাজনৈতিক সমাজ বোঝেনি, অন্তত আমাদের দেশে, যে নাগরিক সমাজের একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে। ২০১১-র পরবর্তীতে যখন সেই নাগরিক সমাজের একাংশ সরাসরি তৃণমূল দলে যোগ দিলেন, তখন মানুষের মধ্যেও সেই একই দ্বন্দ্ব শুরু হল, তবে কি অদলীয় নাগরিক সমাজের কোনো অস্তিত্ব নেই? রাজনৈতিক সমাজ কি এই নাগরিক কণ্ঠস্বর শুনতে রাজি নয়? রাজনৈতিক সমাজ কি নাগরিক সমাজের এই কণ্ঠস্বরের পিছনে সমাবেশিত হতে পারে না? সবসময়ে সামনে আসতে হবে রাজনৈতিক সমাজকে এটা কে ঠিক করে দিয়েছে?
আজকে শোনা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী নাকি বাংলাতে হনুমান মন্দির বানাবেন, তৃণমূল কতটা তার বিরোধিতা করতে পারবে সন্দেহ আছে। বামেরা কি করবে? তাঁরা, তৃণমূল কেন এই প্রকল্পের বিরোধ করছে না, তাই নিয়ে আওয়াজ তুলবে। অথচ বিজেপি কেন এই মন্দির বানাচ্ছে, তার বিরোধ করা হবে সময়ের দাবি। নাগরিক সমাজ কী বলছে, সেই আওয়াজ কিন্তু আগামীদিনে আরও তীব্র হবে, কিন্তু তা কি ঢুকবে বামেদের কানে? নাগরিক সমাজ থেকেই কিন্তু এই হনুমান মন্দিরের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে, স্কুল তৈরি করার, কলেজ বা হাসপাতাল তৈরি করার। এই আওয়াজ কিন্তু আরও বেশ কিছু অদলীয় নাগরিকদের সমাবেশিত করবে। কিন্তু সেই আওয়াজ যদি বামেদের কানে না ঢোকে, তাহলে যে কানাগলিতে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি, খেতেই থাকবো, আর বিজেপি-তৃণমূলের বাইনারির মধ্যেই ঘুরতে থাকব। তখন মনে হবে বারবার, মিডিয়া এই বাইনারি সেট করে দিচ্ছে বলেই সমস্যা হচ্ছে। আসলে নাগরিক সমাজের আওয়াজ শোনা এবং তার পিছনে (সামনে নয়) সমাবেশিত করাটা এখন সময়ের দাবি। কে বলতে পারে, এই অদলীয় নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বরটাই আগামী দিনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে না?
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার। মতামত ব্যক্তিগত।)
Powered by Froala Editor