কেউ অভিনেতা, কেউ শিক্ষাবিদ। আবার কারোর পেশা ক্রীড়াজগৎ। রাজনীতিতে এমন মুখ দেখা যায় হামেশাই। শুধু ভারত বা আজকের সময় বলে নয়, ভিন্নক্ষেত্রের তারকাদের বহু আগে থেকেই দেখা গেছে রাজনৈতিক নির্বাচনী যুদ্ধে। এমনকি বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ও পদার্থবিদ আইনস্টাইনও বাদ যাননি এই তালিকা থেকে। ইজরায়েলের প্রেসিডেন্টের পদপ্রার্থী হিসাবে উঠে এসেছিল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নাম। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল একটু অন্যরকম।
তবে গল্পটা ইজরায়েল থেকে শুরু না করে পিছিয়ে যাওয়া যাক আরও দু-আড়াই দশক। তখনও জার্মানির চান্সেলর হয়ে ওঠেননি অ্যাডলফ হিটলার। সেই তিরিশের দশক থেকেই বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন আইনস্টাইন। তবে সক্রিয়ভাবে কখনোই তিনি জড়াননি রাজনীতিতে।
তখন তিনি সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। যে যুক্তরাষ্ট্রে নিজের শেষ জীবন কাটিয়েছেন আইনস্টাইন, সেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিলেন তিনি। ১৯৩১ সাল। আমেরিকা সফরে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি হিংসার বিরুদ্ধে প্রথম মুখ খোলেন আইনস্টাইন। মিথ্যা ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত ‘স্কটসবোরো বয়েজ’-এর পক্ষেও কথা বলেছিলেন। ওই একই বছরে অক্সফোর্ডে আয়োজিত একটি সেমিনারে ফ্যাসিবাদে মুণ্ডপাত করেন। তখন সদ্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে হিটলারের জার্মানি। বাড়ছে ইহুদিদের হিংসার মাত্রা।
শুধু এখানেই শেষ নয়। ১৯৩২ সালে জেনেভা সম্মেলনে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিরস্তকরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়। আর আন্তর্জাতিক সেই সম্মেলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং তহবিল গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন আইনস্টাইন। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের পর নিজের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তিও দান করে যান জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। ইহুদি বিদ্বেষের জন্য যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও জন্মভূমি জার্মানিতে ফেরেননি তিনি।
এবার এই সূত্র ধরেই আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হয় ইজরায়েলে। স্বাধীনতার পর প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন চেম ওয়েজমান। ইজরায়েলের জিওনিস্ট দলের সক্রিয় কর্মী হলেও, পেশাগত দিক থেকে একজন বায়োকেমিস্ট ছিলেন ওয়েজমান। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকার কারণেই আইনস্টাইনের অন্যতম অনুরাগী ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের অবস্থান এবং আইনস্টাইন নিজেও ইহুদি হওয়ার কারণে তাঁর বাড়তি শ্রদ্ধা ছিলই। ১৯৪৯ সালে একটি বক্তৃতায় ওয়েজমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইহুদি ব্যক্তিত্ব হিসাবে উল্লেখ করেন আইনস্টাইনকে। যা রীতিমতো সাড়াও ফেলে দিয়েছিল ইজরায়েলে। ১৯৫২ সালে ৯ নভেম্বর। ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনই মারা যান চেম ওয়েজমান। এর সপ্তাহ খানেক পরে ১৭ নভেম্বর আইনস্টাইনের কাছে এসে পৌঁছায় একটি চিঠি ইজরায়েলের দূতাবাস থেকে। সেই চিঠি মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতির দায়ভার গ্রহণের অনুরোধপত্র।
আইনস্টাইনকে ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি করার এই প্রস্তাবের মূলে ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন। ওয়েজমানের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে। তবে ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও যে তাঁর বিজ্ঞানচর্চায় কোনোরকম অসুবিধা হবে না সেই আশ্বাসও দিয়েছিলেন ডেভিড। রাজি ছিলেন আইনস্টাইনের গবেষণার সমস্ত খরচার ভারবহনেও।
আরও পড়ুন
আইনস্টাইনের নামাঙ্কিত মৌল, এই প্রথম তৈরি হল গবেষণাগারে
তবে শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আইনস্টাইন। বিশ্বের অন্যতম ‘জিনিয়াস’-এর প্রত্যুত্তর ছিল, রাষ্ট্রপতি হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই তাঁর। সবিনয়েই তিনি জানান তাঁর বার্ধক্য, অনভিজ্ঞতা, এবং অপর্যাপ্ত দক্ষতা ইজরায়েলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে কাঁটা হবে দাঁড়াবে উন্নয়নের। পাশাপাশি রাজনীতির থেকে সমীকরণেই যে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তাও জানান আইনস্টাইন।
তবে রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরেও ইজরায়েলে এতটুকু শ্রদ্ধা কমেনি তাঁর প্রতি। বরং এই মহানুভবতায় বেড়েছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর ইজরায়েলে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি করা হয় আইনস্টাইন স্কোয়ার। শুধু আইনস্টাইন স্কোয়ারই নয়। সব মিলিয়ে আইনস্টাইনের মোট চারটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে ইজরায়েল জুড়ে। এমনকি ১৯৬৮ সালে আইনস্টাইনের ছবিও ছাপা হয় ইজরায়েলের নোটে। ১৯৫২ সালের সেই ঘটনা সারা বিশ্বের বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও, ভুলে যায়নি ইজরায়েল। আজও এই ইহুদি-প্রধান দেশে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয় অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকেই…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কী ছিল আইনস্টাইনের শেষ উচ্চারণ? আজও রহস্য হয়েই থেকে গেছে সে-অধ্যায়