ভ্যালি অফ দ্য কিংস। থিবসের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত এই অঞ্চলেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল প্রাচীন মিশরের বহু ফ্যারাও-এর দেহ। যার মধ্যে সবচেয়ে রহস্যে মোড়া সমাধিটি ছিল এক কিশোর সম্রাটের। ফ্যারাও তুতানখামেন। না, কোনো পিরামিড নয়, সাধারণ পাথরের ঢিবির নিচে সুড়ঙ্গের মধ্যেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে। মাত্র ১১০ বর্গফুটের একটি কক্ষেই শায়িত ছিলেন ‘কিং টাট’। ১৯২২ সালে আবিষ্কৃত হয় রহস্যে মোড়া এই গোপন সমাধিকক্ষ। এবার তুতানখামেনের কফিনের সৌজন্যেই সন্ধান মিলল মিশরের রানি নেফারতিতির সমাধির। সম্প্রতি এমনই দাবি করেছেন ব্রিটিশ ইজিপ্টোলজিস্ট নিকোলাস রিভেস ও মিশরীয় প্রত্নবিদ জাহি হাওয়াস।
তুতানখামেনের মতো নেফারতিতিও (Queen Nefertiti) মিশরের (Egypt) এক রহস্যময়ী চরিত্র। আজ থেকে দেড়শো থেকে দুশো বছর আগেই নেফারতিতির তথ্য হাতে পেয়েছিলেন গবেষকরা। তবে তাঁর সমাধি খুঁজে পাননি গবেষকরা। তবে বছর খানেক আগে হাওয়াস ও রিভেস দাবি করেন, তুতানখামেনের সমাধির কাছেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল রানি নেফারতিতির সমাধি। সম্প্রতি লাক্স-র অর্থাৎ কিংস ভ্যালির পশ্চিমে খননকার্য চালিয়ে দুটি নামহীন মমি উদ্ধার করেছেন তাঁরা। প্রত্নতত্ত্বের হিসাবে তাদের নাম রাখা হয়েছে ‘কেভিই ২১এ’ এবং ‘কেভি ২১বি’। এই দুটি মমির মধ্যেই একটি নেফারতিতির এমনটাই দাবি তাঁদের। কিন্তু কীভাবে সন্ধান মিলল এই দুই মমির?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ৩৩০০ বছর আগে। সম্পর্কে নেফারতিতি ছিলেন তুতানখামেনের শাশুড়ি। আবার সৎ মা-ও। বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক। চতুর্থ আখেনআতেনের স্ত্রী ছিলেন নেফারতিতি। সাতটি কন্যা থাকলেও কোনো পুত্রসন্তান ছিল না তাঁদের। অন্যদিকে তুতানখামেন ছিলেন আখেনআতেন ও তাঁর বোনের সন্তান। আবার নেফারতিতির সাত কন্যার মধ্যে একজনের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তুতানখামেনের। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তিনি নেফারতিতির জামাই, আবার পালিত সন্তানও বটে।
আখেনআতেন বা আমেনহোটেপের মৃত্যুর পর মিশরের সিংহাসনে বসেন অপরূপ সুন্দরী রানি নেফারতিতি। আনুমানিক ১৩৭০ থেকে ১৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তিনি মিশরের রাজত্ব করেছেন বলেই মনে করেন বহু মিশরীয় গবেষক। নেফারতিতির পর মিশরের রাজকার্যের ভার আসে ফ্যারাও তুতানখামেনের হাতে।
স্বাভাবিকভাবেই সৎ মা-এর দেহ সমাধি করেছিলেন তুতানখামেনই, এমনটা বহু আগে থেকেই ভেবে এসেছিলেন ইজিপ্টোলজিস্টরা। কিন্তু কোথায়? হাওয়াস এবং রিভেস এখানে প্রমাণ তুলে ধরেছেন তুতানখামেনের কফিনের ওপর আঁকা একগুচ্ছ ছবিকে। তুতানখামেনের কফিনের উপর দুটি সারিতে আঁকা হয়েছিল ছবিগুলি। প্রথমসারিতে ছিল তুতানখামেনকে সমাধিস্থ করার ছবি। হাওয়াস ও রিভেসের ধারণা, তাঁর উত্তরসূরি আই-ই সমাধিস্থ করছেন তাঁকে, এমনটাই অর্থ দাঁড়ায় এই ছবি থেকে। অন্যদিকে দ্বিতীয় সারিতে ছিল আরও এক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করার ছবি। তুলনামূলকভাবে ঝাপসা হওয়ায়, তা দীর্ঘদিন নজর এড়িয়ে গেছে গবেষকদের। হাওয়াস এবং রিভেসের অভিমত, দ্বিতীয় সারির ছবিতে আঁকা এই মমিটি আসলে নেফারতিতির। আর তাঁকে যিনি সমাধিস্থ করছেন, তিনি স্বয়ং তুতানখামেন।
এই ছবি থেকেই ধারণা করা হয়, তুতানখামেনের সমাধির নিকটেই কোনো গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রয়েছেন রানি নেফারতিতি। সেই সূত্র ধরেই শুরু হয়েছিল খননকার্য। খুঁজে পাওয়া যায় নতুন দুটি নামহীন মমি। কিন্তু এই দুটি মধ্যেই যে একটি রানি নেফারতিতির— তাঁর প্রমাণ কী?
এই প্রমাণ পেশ করার জন্যই মাস খানেক সময় চেয়ে নিয়েছেন দুই গবেষক। এর আগে তুতানখামেন, আখেনহোটেপ এবং তুতানখামেনের স্ত্রী-এর সমাধি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল তাঁদের ডিএনএ নমুনা। আখেনহোটেপ, তুতানখামেনের স্ত্রী-এর সেই ডিএনএ-এর সঙ্গেই মিলিয়ে দেখা হবে সংশ্লিষ্ট নতুন দুটি মমির ডিএনএ-কে। আর তা মিললেই যবনিকা পতন হবে প্রাচীন মিশরের এক রহস্যময় অধ্যায়ের। পাজেলের এই শেষ অংশটাই মেলানোর কাজ চলছে ল্যাবরেটরিতে। আগামী অক্টোবরেই এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসবে বলে আশাবাদী দুই ইজিপ্টোলজিস্ট…
Powered by Froala Editor